ফ্রান্স থেকে পাওয়া সংবাদ এবং ব্যাক্তি উদ্যোগে তা নিশ্চিত হবার পর আমরা অত্যন্ত শোকের সাথে আপনাদের জানাচ্ছি, উপমহাদেশের প্রথম আধুনিক নারী ভাস্কর নভেরা আহমেদ, ( তিনি শহীদ মিনারের যৌথ নকশাকারী) কিছুক্ষণ পূর্বে চিরতরে না ফেরার দেশে চলে গিয়েছেন। আমরা এই অভিমানী শিল্পীর আত্মার শান্তি প্রার্থনা করছি।
ছবির মানুষটিকে নিয়ে খুব বেশি বলতে পারবো না, জানিও না। অনেকেই জানেন না। কারণ তিনি ছিলেন রহস্যময়। এই রহস্যময় মানুষটির নাম নভেরা। নভেরা আহমেদ। বাংলাদেশের প্রথম আধুনিক ভাস্কর (জন্ম আনুমানিক ১৯৩০) মেধাবী, দুঃসাহসী, রহস্যময় এক ভাস্কর্য শিল্পী।
যুক্তরাজ্যের ড. বোগেল এবং ইটালির ভেঞ্চুরিও ভেঞ্চুরি’র কাছ থেকে নভেরা ভাস্কর্যের ওপর শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন নভেরা, বর্তমান শহীদ মিনারটির নকশায় তিনি শিল্পী হামিদুর রহমানকে সহায়তা দিয়েছিলেন।
১৯৫৭ সালে হামিদুর রহমানের সঙ্গে জলাধার-অলংকরণে বৃক্ষ ও পত্রপল্লবের সমাহারসহ তিনি যেভাবে শহীদ মিনারের প্রকৃত নকশা দিয়েছিলেন তা আজও বাস্তবায়িত হয়নি। তিনি ছিলেন প্রস্ববণী-ভাস্কর্য নকশায় বিশেষ পারদর্শী। সেই ধারণায় একটি নতুন ভূমিচিত্র তিনি শহীদ মিনারের প্রকৃত নির্মাণ চেয়েছিলেন। যেখানে প্রতিবিম্বিত হবে চির শান্তির ছায়া। কিন্তু ১৯৫৮ সালের শেষের দিকে আইয়ূব খান সামরিক আইন জারী করলে তার সমস্ত পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।সরকারি খাতায় নভেরার নাম না থাকায় শহীদ মিনারের নকশা পরিকল্পনায় তাঁর অবদানের প্রসঙ্গটি বিতর্কিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
১৯৫৮ সালের ২১ ফেব্র“য়ারির The Pakistan Observer-এর প্রথম পাতায় শহীদ মিনার সম্পর্কিত খবর দিয়ে যে-প্রতিবেদনটি যুক্ত হলো তার একটি বাক্য ছিল : … The memorial has been designed by Mr. Hamidur Rahman in collaboration with miss. Novera Ahmed…. ’৫২-র ২১ ফেব্র“য়ারির রাতে যাঁরা শহীদ মিনার গেঁথে তোলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র কবি রফিক আহমেদ – নির্মাণাধীন শহীদ মিনারে তাঁর নিত্য যাতায়াত ছিল – তিনি জানেন শিল্পীদ্বয়ের যৌথ অবদানের কথা। এই শিল্পীদ্বয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন আমিনুল ইসলাম – তিনি বলেছেন একটি সত্য যে কালের হাতে কত সহজে বিস্মৃতি ও বিভ্রান্তিতে পরিণত হতে পারে এখানেই তার প্রমাণ। সৈয়দ মহম্মদ আলী বলেছিলেন, Novera had a major contribution in designing the shaheed minar.’
১৯৫০ সালে, নভেরা লন্ডনে যান এবং লন্ডন, ইতালি ও প্যারিস থেকে ভাস্কর্যে পাঠ, প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা লাভ করেন। দেশে ফিরে তিনি আধুনিক ভাস্কর্যরীতির সঙ্গে লোকজ ফর্মের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে কাজ করেছিলেন। বিষয়লগ্ন ও বিষয়বিচ্ছিন্ন উভয় প্রকারের কাজই করেছেন – এক একটি বিশেষ চিন্তার রূপক হিসেবে ভাস্কর্যগুলো মূর্ত হয়েছে – এদের প্রকাশভঙ্গি নভেরার জন্যে স্বাভাবিকই ছিল, কিন্তু এখানে তা অভিনব মনে হয়েছে এবং তাঁর শিল্পীজীবনের প্রাথমিক পর্যায়ের এইসব কাজে প্রতিভার পরিচয় আছে। তাঁর স্মরণীয় হবার দাবি কেবল কালের বিচারে নয়, প্রতিভাবান শিল্পীর মর্যাদায়ও।
১৯৫৬ সালের মধ্যভাগ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত নভেরা দেশে ছিলেন এবং এই পাঁচ-ছবছরে তিনি যে-কাজ করেছেন তা একজন শিল্পীর প্রস্তুতি পর্বের কাজ হিসেবেই ধরা যায় – একজন শিল্পীকে শিল্পী হয়ে ওঠার জন্য এ-সময়ের প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু নভেরা তাঁর প্রথম জীবনের কাজ দিয়েই আমাদের কাছে পরিচিত। ইউরোপের আধুনিক ভাবধারার সঙ্গে তিনি দেশীয় বিষয় ও টেকনিকের সাহায্য মিলিয়ে কাজ করেছিলেন। ইউরোপে ব্রোঞ্জ ও অন্যান্য ধাতু দিয়ে যে কাজ হচ্ছিল আমাদের দেশে তখন তা সম্ভব ছিল না। নভেরা লোহার রডের আরমেকার বা খাঁচা তৈরি করে তার ওপর সুরকি ও সিমেন্ট ব্যবহার করেছেন আর কাঠের কাজও কিছু করেছেন। তাঁর ‘পিস’ কাজটি ছাড়া শহীদ মিনারের মতো সম্পূর্ণ বিমূর্ত কাজ আর করেননি।
নভেরা যে স্বদেশ, আত্মীয়-পরিজন এবং বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন সে অনেকদিনের কথা।১৯৭৪ সালে ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে নভেরার দেখা হয় – ডক্টর হোসেন তাঁর জন্য একটি সরকারি অনুদানের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু বিষয়টি কার্যকর হবার আগেই ১৯৭৫-এর আগস্ট এসে যায়। নভেরা এতটাই আত্মগোপন করতে সমর্থ হয়েছিলেন যে, এস এম আলী শুনেছিলেন নভেরা আর নেই – সেটা ১৯৮৯ সালের কথা। এবং সকলেরই এরকম একটা নিশ্চিত ধারণা হয়েছিল যে তিনি নেই। নভেরা অত্যন্ত স্বাধীনচেতা মানুষ ছিলেন, কিন্তু আর্থিক স্বনির্ভরতা ছাড়া তো সেটা একেবারেই সম্ভব নয়। চাকরি? কিন্তু সেখানেও তো পরাধীনতার প্রশ্ন থাকে, তবে মালিন্য হয়তো থাকে না।
জাদুঘরের একটি হলের নামকরণ হয়েছে ‘ভাস্কর নভেরা আহমেদ হল’। ’৯৫ সালের মার্চ মাসে প্যারিসে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত কে এম সেহাবুদ্দিন নভেরার মামাতো ভাই বি.আর. নিজামকে জানান যে, নভেরা বেঁচে আছেন এবং বাংলাদেশ দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগও করেছেন।
হামিদুর রহমান ১৯৮৯ সালে মারা যান। আর নভেরা আহমেদ নিরবে চলে যান কোন ঠিকানা না রেখেই।
**১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার ভাস্কর্যে তাঁর অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ নভেরা আহমেদকে একুশে পদক দিয়ে সম্মানিত করেন।সেই সম্মাননা গ্রহণের জন্যও নভেরা দেশে আসেননি! শিল্পী শাহাবুদ্দিনের হাত থেকে তিনি এই সম্মাননা গ্রহণ করেন প্যারিসের এক হোটেলে।
নভেরা আহমেদ, ভাস্কর্যের অগ্রণী আধুনিকতম শিল্পী
—————————————————————–
এখনও তিনি প্যারিসে লোকচক্ষুর আড়ালেই রয়েছেন। পৃথিবী থেকেও চলে গেলেন আজ। কিন্তু তাঁর ভাস্কর্যগুলো চিরকাল বলে যাবে, সময়ের চেয়ে অগ্রগামী এক নারী জন্মেছিলেন, তাঁর নাম নভেরা। তিনি ছিলেন আছেন… থাকবেন… শিল্পীর মৃত্যু নেই।
আজো বেঁচে আছেন। খুব সম্ভব প্যারিসের কাছাকাছি কোথাও থাকেন। তিনি আজ পর্যন্ত বাংলাদেশী পাসপোর্ট বিসর্জন দেননি, এবং ২০০৯ সালের একটি তথ্য থেকে জানতে পারি তিনি প্যারিসের বাংলাদেশী দূতাবাস থেকে নতুন পাসপোর্ট সংগ্রহ করেছিলেন। তবে, দূতাবাসের কর্মকর্তার সাথে বাঙলায় কথা বলেননি।
**১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার ভাস্কর্যে তাঁর অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ নভেরা আহমেদকে একুশে পদক দিয়ে সম্মানিত করেন।সেই সম্মাননা গ্রহণের জন্যও নভেরা দেশে আসেননি! শিল্পী শাহাবুদ্দিনের হাত থেকে তিনি এই সম্মাননা গ্রহণ করেন প্যারিসের এক হোটেলে।
নভেরা, ভাস্কর নভেরা আহমেদ, এতদিন তার প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত বলে আমাদের খেদের অন্ত নেই, বিস্ময়ের সীমা নেই। আমাদের এ বিস্ময়ে বা খেদোক্তিতে হয়তো আন্তরিক সততা আছে ষোল আনাই, কিন্তু ইতিহাসবোধ যে যথেষ্ট পরিমাণ কম তা সন্দেহহীন।
অপূর্ব সুন্দরী ছিলেন। পোশাক আশাকে এত আধুনিক ছিলেন যা সে সময়ের ঢাকা শহরে দেখা যেত না। কালো রঙের শাড়ি পরতেন, গলায় থাকত নানা রকম রঙিন মালা। শহীদ মিনারের নিচে পূর্ব-দক্ষিণ দিক ঘিরে একটি গ্যালারি ছিল। কথা ছিল ওখানে একটি লাইব্রেরিও হবে। দেয়ালে থাকবে শহীদদের প্রতি নিবেদিত এবং বাংলাভাষা বিষয়ক কিছু ম্যুরাল। হামিদুর রহমান বেশ কিছু ম্যুরাল করেও ফেলেছিলেন। শুনেছি মূল নকশা অনুযায়ী যেমন শহীদ মিনার শেষ করতে পারেননি তেমনি ম্যুরালগুলোও শেষ করতে পারেননি। ‘৭১ সাল পর্যন্ত যে শহীদ মিনারটি আমরা পেয়েছিলাম তা অসম্পূর্ণ ছিল। দেয়াল চিত্রগুলো ১৮৫৬-এর পরে আর এগোয়নি, সে সঙ্গে বলা যায় নভেরা আহমেদের যে ক’টি ম্যুরাল শহীদ মিনার চত্বরে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তৈরি হচ্ছিল, তা আর আলোর মুখ দেখতে পারেনি।
১৯৫৯ কিংবা ১৯৬০’এর দিকে নভেরা লাহোর চলে যান। একষট্টি সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ‘ন্যাশনাল এক্সিবিশন অব পেইন্টিং স্কাল্পচার এ্যান্ড গ্রাফিক আর্টস নামে এটি প্রদর্শনীতে তার ছ’টি ভাস্কর্য স্থান পেয়েছিল। প্রদর্শনীতে ‘চাইল্ড ফিলোসফার’ নামে তাঁর একটি ভাস্কর্য ‘বেস্ট স্কাল্পচার’ পুরস্কার পায়। নভেরার সে পুরস্কার শুধু নারী ভাস্কর্যর হিসেবে নয় শিল্পকর্ম হিসেবে ভাস্কর্যের প্রথম স্বীকৃতি ছিল। এর আগে পশ্চিম পাকিস্তানে ভাস্কর্য করার ওপর এক ধরনের অলিখিত নিষেধাজ্ঞা ছিল। লাহোরে কয়েক বছর থাকার পর নভেরা চলে যান বোম্বেতে। সেখানে ইসমত চুগতাইর বাড়িতে কিছুদিন ছিলেন। বোম্বে থেকে প্যারিসে তারপর আবার গিয়েছিলেন লাহোরে। বেশিদিন থাকেননি। বিভিন্ন দেশ ঘুরে শেষে প্যারিসেই স্থায়ী হন। সম্ভবত ১৯৮৮তে সড়ক দুর্ঘটনায় একটি পা হারান সে সময় খুব অর্থকষ্টেও নাকি ছিলেন।
একজন শিল্পী হিসেবে তিনি সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলেন। উন্নত দেশের আধুনিক ধারার ভাস্কর্যের সঙ্গে পরিচয় ছিল নভেরার এবং সে ধারার সঙ্গে নিজের কাজ যুক্ত করে দেশীয় একটি ঘরানা তৈরি করেছিলেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি, পাবলিক লাইব্রেরি ও চারুকলা চত্বরে তিনি যে ভাস্কর্য করেছিলেন সেগুলো অজত্নে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল। রাষ্ট্র, সমাজ এমনকি শিল্পীরাও তার ভাস্কর্যকে অবহেলা করেছেন। যে জন্য এ অপূর্ব ভাস্কর্যের অনেকগুলোই প্রায় পুরো নষ্ট হয়েছে কিছু কিছু ভাস্কর্যের অংশবিশেষ নষ্ট হয়েছে। দীর্ঘদিন পর গত শতকের নব্বই দশকে নভেরা আহমেদের ভাস্কর্য, শহীদ মিনারের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা ইত্যাদি আবার গুরুত্ব পেতে থাকে। গত আওয়ামী সরকারের আমলে শিল্পকলা একাডেমী ও জাদুঘর নভেরার ভাস্কর্য সংরক্ষণে বেশ কিছু উদ্যোগ নেয়। পাবলিক লাইব্রেরির সামনে ভাস্কর্যগুলো সংরক্ষণ করে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। জাদুঘর কর্তৃপক্ষ তখন নভেরা আহমেদের একটি প্রদর্শনীও করেছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে সম্মানিত করতে একুশে পদক দিয়েছিলেন। তিনি প্যারিসে বিশেষ দূতও পাঠিয়েছিলেন নভেরাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে, কিন্তু তিনি আসেননি।
সেই পঞ্চাশের দশকে যখন এদেশে শিল্পকলার প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা হাঁটি হাঁটি পা পা করছে সে সময় একজন নারীর ভাস্কর হিসেবে বিকশিত হওয়া সহজ কথা নয়। তাঁর ভাস্কর্য দেখলে, তাঁর জীবন সম্পর্কে কৌতূহল জাগবেই।