দলকে গতিশীল করতে- তরুণ নেতৃত্বে দৃষ্টি বিএনপির

নিষ্ক্রিয় ও বয়স্কদের বাদ দিয়ে তরুণ এবং ডায়নামিক নেতাদের দলের বিভিন্ন স্তরের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিতে চাইছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। দলকে গতিশীল ও সাংগঠনিক ভিত মজবুত করাসহ সরকারবিরোধী আন্দোলন সফল করতে তিনি এমন চিন্তা করছেন। তিন সিটি নির্বাচনের পর দলের বেশ কয়েকজন নীতিনির্ধারকের সঙ্গে আলাপকালে খালেদা জিয়া এমন আভাস দিয়েছেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।

আরও জানা গেছে, ক্ষমতাসীন দল নানা অত্যাচার-নির্যাতনের মাধ্যমে আন্দোলন দমানোর চেষ্টা করলেও দলের একটি অংশ আন্দোলনে যতটা সক্রিয় থাকার কথা ছিল ততটা সক্রিয় ছিল না বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া দলের হয়ে যারা বিদেশী কূটনীতিকদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের কাজ করতেন তাদেরও ব্যর্থতা ফুটে উঠেছে। সদ্য অনুষ্ঠিত সিটি নির্বাচনে দলের সাবেক সংসদ সদস্যদের ঢাকা ও চট্টগ্রামে প্রচারে নামতে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বেশিরভাগ নেতাই এ নির্দেশ মানেননি। সব মিলিয়েই বিএনপির চেয়ারপারসন সংশ্লিষ্ট নেতাদের ওপর ক্ষুব্ধ।

খালেদা জিয়ার ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ক্ষুব্ধ খালেদা জিয়া কিছু তরুণ, মেধাবী ও দলের জন্য নিবেদিত এবং ডায়নামিক নেতৃত্বের প্রয়োজন অনুভব করছেন। দলের প্রতি শতভাগ আনুগত্য কূটনীতিক ও রাজনৈতিক এবং ডিজিটাল বিষয়েও সম্ভাব্য তরুণ নেতাদের বেশ পারদর্শী হতে হবে। তাদের সরাসরি দলের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়া হতে পারে অথবা দলের বাইরে রেখে দিকনির্দেশনা অনুযায়ী বিশেষ অ্যাসাইনমেন্ট সম্পন্ন করবেন তারা।
দলীয় সূত্র জানায়, উত্তর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে তরুণ তাবিথ আউয়ালকে সমর্থন ও তার কর্মকাণ্ডে মুগ্ধ খালেদা জিয়া। এ ছাড়া আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাসের ভূমিকায়ও বেশ খুশি চেয়ারপারসন। তার ধারণা, তাবিথ বা আফরোজা আব্বাসদের মতো ডায়নামিক নতুনদের সামনের কাতারে এনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিলে আন্দোলনে সফলতার পাশাপাশি দলেও গতিশীলতা আসবে।
জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মোহাম্মদ শাহাজহান বুধবার টেলিফোনে বলেন, সরকারের কঠোর দমনপীড়নের কারণে আন্দোলনে হোঁচট খেলেও বিএনপি যেকোনো সময় ঘুরে দাঁড়াতে পারে। এখানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় কর্মীরা যাকে নেতা মানেন তাকে নেতৃত্বে এনে যদি দল পুনর্গঠন করা হয় তাহলেই তা সম্ভব। বিএনপির বিশাল একটি কর্মী বাহিনী আছে। সিটি নির্বাচন ও আরাফাত রহমান কোকোর জানাজায় তা প্রমাণিত হয়েছে। ত্যাগী ও তরুণদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আনা হলে তৃণমূলে আবার চাঙ্গাভাব দেখা দেবে। দলে মূল্যায়িত হবেন এমন প্রত্যাশায় তারাও যেকোনো ঝুঁকি নিতে সাহস পাবেন।

বিএনপির একজন নীতিনির্ধারক জানান, এর আগে বেশ কয়েকবার তরুণ ও ত্যাগীদের সমন্বয়ে পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিলেও দলের কয়েকজন নেতার কারণে তা সম্ভব হয়নি। কয়েক দফা আন্দোলনে ব্যর্থতার পর আবারও তরুণ ও ত্যাগী নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়ার দাবি জোরালো হয়ে ওঠেছে। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পাশাপাশি সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানও চাচ্ছেন মেধাবী ও ডায়নামিক তরুণরা গুরুত্বপূর্ণ পদের দায়িত্বপালন করুক।
জানা যায়, পদে থেকে বা না থেকেও যেসব তরুণ নেতা আন্দোলন-সংগ্রামে অপেক্ষাকৃত সক্রিয় ছিল তাদের অগ্রাধিকার দিয়ে সংগঠন গোছানোর পরিকল্পনা করেছে দলটি। বিশেষ করে ছাত্রদল ও যুবদলের সাবেক ডায়নামিক নেতাদের সামনে আনতে চায়। বিশেষ কোনো নেতা বা বলয়ের ওপর গুরুত্ব না দিয়ে আন্দোলন-সংগ্রামে বাস্তব অর্থে যারা ভূমিকা রাখতে পারবেন তাদেরই এবার মূল্যায়ন করা হবে। দলের কাউন্সিল নিয়েও খালেদা জিয়ার সঙ্গে নেতারা আলোচনা করেছেন। দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জামিনে মুক্ত হওয়ার পর দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে কাউন্সিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হতে পারে। এ ছাড়া সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত কয়েকজন নেতাকেও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়ে আবারও দলে সক্রিয় হওয়ার সুযোগ দেয়া হতে পারে। ইতিমধ্যে এ নিয়ে কাজ করেছেন কয়েকজন নেতা।
দল পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত দলের বেশ কয়েকজন নেতা বলেন, নব্বইয়ের দশকে এমনকি ৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে মূল নেতৃত্বে ছিল তরুণরা। চাওয়া-পাওয়ার কোনো হিসাব না করে দলের জন্য তারা কাজ করেছে। যেকোনো ঝুঁকি নিতেও তারা পিছপা হয়নি। কিন্তু ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পরই সবকিছু পাল্টে যায়। সুবিধাভোগী ও সুযোগসন্ধানীদের দখলে চলে যায় দল। ত্যাগী নেতাদের কোনো মূল্যায়ন করা হয়নি। ধীরে ধীরে দলটি সুযোগসন্ধানীদের দখলে চলে যায়। যার প্রমাণ মেলে সরকারবিরোধী আন্দোলনে। ঝুঁকি নেয়ার পরও মূল্যায়ন করা হবে না এমন আশংকায় অনেকেই রাজপথে নামেননি। বিগত সময়ে যারা সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন দলের দুঃসময়ে তারা সটকে পড়েন। এমন বাস্তবতায় আবারও নতুন করে দল পুনর্গঠনের দাবি জোরালো হচ্ছে। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানও বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরেছেন।
সূত্র জানায়, দলীয় নেতাকর্মীদের পাশাপাশি নব্বই ও ৯৬ সালের আন্দোলনে ছাত্র, শিক্ষক, ডাক্তার, আইনজীবী এবং শ্রমিক সংগঠনগুলোকে সম্পৃক্ত করা গিয়েছিল। কিন্তু এবারের আন্দোলনে বিএনপি বা তার জোটের নেতা ছাড়া কাউকেই সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত করা যায়নি। এ বিষয়ে তেমন কোনো রাজনৈতিক নেতাকেও দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়নি। দু-একজন উদ্যোগ নিলেও সরকারের কঠোর দমননীতির কারণে তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। একই সঙ্গে যারা দলের প্রতি কমিটেড ছিলেন সেসব পেশাজীবীকেও যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়নি। নেতাদের পাশাপাশি সুযোগসন্ধানী পেশাজীবীরা দল ক্ষমতায় থাকাকালে নানা সুবিধা নিলেও দুঃসময়ে তারাও পাশে দাঁড়াননি। দল পুনর্গঠনের পাশাপাশি পেশাজীবীদের নিয়ে একটি শক্তিশালী বলয় গড়ে তোলার চিন্তাভাবনা চলছে। এ জন্য দলের কয়েকজন নেতাকে সুনির্দিষ্টভাবে দায়িত্ব দেয়া হতে পারে।

সূত্র জানায়, বিগত আন্দোলনে সবার মধ্যে একটা সমন্বয় ছিল। ওই সময়ে ইচ্ছা করলেই চেয়ারপারসনের সঙ্গে কথা বলা যেত এবং নির্দেশনা পাওয়া যেত। কিন্তু এখন তার সঙ্গে কথা বলা অকেটাই কঠিন। দলের চেয়ারপারসনকে আমলাতান্ত্রিক বলয়ে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। ফলে মাঠের প্রকৃত চিত্র অনেক সময় তিনি জানতে পারেন না। এতে অনেক সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হয় না।
একাধিক নীতিনির্ধারকের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, আন্দোলন-সংগ্রামের সফলতা নিয়ে যাদের ওপর এতদিন ভরসা করতেন তাদের ব্যর্থতায় বিএনপির চেয়ারপারসন যথেষ্ট ক্ষুব্ধ বলে জানিয়েছে খালেদা জিয়ার ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র। এ বিষয়ে দলের এক নেতা জানান, বিএনপির চেয়ারপারসনের ক্ষুব্ধ হওয়ার বেশকিছু কারণ আছে। গত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে দলের হয়ে কূটনীতিক বিষয়ে যারা দেখভাল করতেন তারা বারবারই বিএনপির চেয়ারপারসনকে আশা দেখিয়েছেন। নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর তারাই আবার আন্দোলন বন্ধ করতে খালেদা জিয়াকে পরামর্শ দেন। নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর ছয় মাসের মধ্যে সরকার নির্বাচন দিতে বাধ্য হবে বলে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের বরাত দিয়ে স্বপ্ন দেখানো হয়েছে। অথচ দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিএনপিকে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিলেও কূটনীতিক ও দলের কিছু নেতার পরামর্শে আন্দোলন বন্ধ করেন খালেদা জিয়া।

ওই নীতিনির্ধারকরা আরও মনে করেন, যতক্ষণ পর্যন্ত দলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা না হবে; ততক্ষণ পর্যন্ত কেনোকিছু করেই লাভ হবে না। বিভিন্ন কৌশল করে ক্ষমতাসীনরা আন্দোলন দমাতে চাইবে। এ অবস্থায় যদি কোনো নেতার বৈধ বা অবৈধ কোনো ব্যবসা থাকে তা টিকিয়ে রাখতে বেশি সময় ব্যয় করবেন এটাই স্বাভাবিক। তাই বয়সে যারা তরুণ, শিক্ষিত এবং দলের জন্য নিবেদিত তাদেরই দায়িত্ব দেয়া উচিত। যারা নিজের সম্পদ রক্ষায় নয়, দলের জন্য কাজ করবেন। খালেদা জিয়া বা তারেক রহমানের নাম ভাঙিয়ে সুবিধা নেবেন না এমন নেতাদেরই দায়িত্ব দিতে হবে।

তাদের মতে, দল পুনর্গঠনে তরুণদের অগ্রাধিকার দেয়ার যে চিন্তা হাইকমান্ডের রয়েছে তা বাস্তবায়ন করতে হলে দলের চেয়ারপারসনকে সরাসরি ভূমিকা রাখতে হবে। অথবা দলের মধ্যে অপেক্ষাকৃত নিরপেক্ষ- এমন নেতাদের এ দায়িত্ব দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে প্রথমেই রাজধানী ঢাকার প্রতিটি ওয়ার্ডের মূল দলসহ অঙ্গসংগঠনের কমিটি গঠন করতে হবে। সে ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে সাত দিনের বেশি সময় দেয়া যাবে না। এ ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেয়া যাবে না বলে মন্তব্য ওই নীতিনির্ধারকদের।

Print
1736 মোট পাঠক সংখ্যা 1 আজকের পাঠক সংখ্যা

About jexpress

Close