নৌকায় করে মালয়েশিয়া যাত্রা থেমে নেই। প্রতি মুহূর্তে প্রাণের শঙ্কা, তবু চলছে এ যাত্রা। বেশি উপার্জন, ভালো চাকরির প্রলোভনে ভুলছেন অনেকেই। পরে সাগরে রক্ত মাংসের শরীরটি শুধু নয়, ভাসছে-ডুবছে তাদের পরিবার-জীবন। শুধুই অর্থ উপার্জনের লোভে এ যাত্রা? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে অনেক তথ্য। অনুসন্ধানে জানা যায়, কক্সবাজার থেকে এ যাত্রায় অভিবাসী বাংলাদেশিদের চেয়ে অপহৃতের সংখ্যাই বেশি।
সম্প্রতি মানবপাচারের নামে যেসব বাংলাদেশি অভিবাসীদের কথা বলা হচ্ছে, এদের বড় অংশেরই গন্তব্য মালয়েশিয়া ছিলো না। সাগরের পাড় থেকে বা নির্জন স্থান থেকে অপহরণ করে নৌকায় ওঠানো হয় তাদের। জেলে, শ্রমিক, ব্যাবসায়ী থেকে শুরু করে পর্যটক পর্যন্ত অপহরণের ঘটনা ঘটছে কক্সবাজারে।
দেড় মাস আগে পাবনা থেকে কক্সবাজার বেড়াতে এসেছিলেন তিন বন্ধু। বেড়াতে আসার দ্বিতীয় দিনেই অপহৃত হন তারা। অপহরণকারীরা তাদের তুলে দেয় মালয়েশিয়াগামী ট্রলারে। প্রাণ বাঁচাতে ওই ট্রলার থেকে সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়া একজন উদ্ধার হলেও নিখোঁজ রয়েছে অন্য দুই বন্ধু।
উদ্ধার হওয়া ওই যুবক পাবনার আমিনপুর বাতিখয়া দক্ষিণ পাড়া এলাকার হালিম উল্লাহ ছেলে শহিদুল ইসলাম (২০)। নিখোঁজ রয়েছেন তার বন্ধু পিয়ার (২০) ও আল আমিন (২১)।
উদ্ধার হওয়া শহিদুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, নৌকা ভ্রমণ করার কথা জানিয়ে মাঝি তাদের নিয়ে যায় মহেশখালীতে। সন্ধ্যা হলে মাঝির নেতৃত্বে ৫/৬ জন লোক অস্ত্র ঠেকিয়ে তাদের আটক করে।
দু’দিন পরে একটি মাছের ট্রলারে করে গভীর সাগরে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের। এরপর তুলে দেওয়া হয় অন্য একটি ট্রলারে। যেখানে আগে থেকেই ছিলেন আরও ৭০ জন যাত্রী। গভীর সাগরে প্রায় ৭৩ জন যাত্রী নিয়ে ট্রলারটি ভাসমান থাকে ৪০ দিন।
উদ্ধার হওয়া ওই যুবক আরও জানান, ট্রলারে অবস্থান করা দালালরা বলেন আবছার তাদের জনপ্রতি ৩০ হাজার টাকা করে বিক্রি করে দিয়েছেন।
চট্টগ্রামের বাশঁখালী এলাকায় দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরিতে মাটি কাটার কাজ করতেন আহমেদ হোসেনসহ ছয়জন। প্রতিবেশী দালাল ইউনুসের প্ররোচণায় ৬শ টাকা মজুরিতে কাজ করতে টেকনাফ যান ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর। একদিন পরেই রাতের বেলা তাদের মারধর করে বেঁধে ট্রলারে তুলে দেওয়া হয়।
পরে দুই লাখ টাকা মুক্তিপণ দিলে থাইল্যান্ডের দালালরা জীবন বাঁচিয়ে রেখে পুলিশের হাতে তুল দেন। ১১ মাস জেল খেটে ২০১৪ সালের নভেম্বরে দেশে ফেরেন তারা।
একইভাবে বিধবা শামসুন্নাহারের একমাত্র ছেলে ষোল বছরের কিশোর একরামকেও অপহরণের পর পাচার করে দালালচক্র। থাইল্যান্ডের জঙ্গলে নিয়ে জিম্মি করে তিন লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায় করা হয়। এরপরও ছেলেকে ফিরে পাননি তিনি।
পাচারকারীরা বিধবাকে পিটিয়ে হাড় ভেঙে দিয়েও রেহাই দেয়নি। উল্টো ডাকাতি মামলার আসামি করে ৬০ বছরের এ বৃদ্ধাকে করেছে এলাকাছাড়া।
গত জানুয়ারি মাসে অপহরণ করা হয় একরাকমকে। অপহরণকারীরা থাইল্যান্ডে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করে মুক্তিপণ দাবি করে। ছেলেকে বাঁচাতে ভিটে মাটি বিক্রি ও ধার দেনা করে তিন লাখ টাকা তুলে দেন স্থানীয় দালাল রফিক ও মোকতার আহমদের হাতে। কিন্তু প্রত্যাশিত টাকা পাওয়ার পরও ফেরত পাননি ছেলেকে। এরমধ্যে দালালচক্রের সদস্যরাও গা ঢাকা দিয়েছেন।
মানবপাচার নিয়ে মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে বেসরকারি সংস্থা হেল্প। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক আবুল কাশেম বাংলানিউজকে বলেন, বর্তমানে মানবপাচারের নামে যে কেসগুলো আসছে তার ৫৫ শতাংশই অপহরণ। এরা মালয়েশিয়া যেতে চেয়েছে এমন নয়।
এদিকে অপহরণের পর আবার বেঁচে আসাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মুক্তিপণ আদায় করেই সাগরে ভাসমান মালয়েশিয়াগামী অভিবাসীদের জাহাজ থেকে ফিশিং ট্রলারে তুলে দিচ্ছে পাচারকারীরা।
১৯ মে টেকনাফের শাহপরী দ্বীপ থেকে উদ্ধার হন ঝিনাইদহের কালিরছড়া গ্রামের মুশফিকুর বিশ্বাসের ছেলে শহীদ গাজী (১৭)।
বাংলানিউজকে তিনি জানান, ৪৫ দিন আগে ভালো বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে তার চাচাত ভাই সাগরপথে মালয়েশিয়ায় নেওয়ার জন্য কক্সবাজার নিয়ে আসে। পরেরে বুঝতে পারেন তিনি কিডন্যাপ হয়েছেন। মহেশখালীতে লুতু দালালের কাছে বিক্রি করে দেয় তার চাচাতো ভাই। ওইদিন রাতেই তাকে একটি ফিশিং ট্রলারে তুলে দেয় লুতু।
সেখান থেকে একদিন গভীর সাগরে একটি জাহাজে নেওয়া হয়। আর জাহাজে নেওয়ার পর থেকে শুরু হয় নির্যাতন।
তিনি বলেন, পরে বিকাশের মাধ্যমে প্রথম দফায় ২০ হাজার ও দ্বিতীয় দফায় আরও ১০ হাজার টাকা দিলে আমিসহ মোট ১৯ জনকে একটি ফিশিং ট্রলারে তুলে দেয় পাচারকারীরা।
এ বিষয়ে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তোফায়েল আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, মানবপাচার আইনে মামলাগুলো হয়। অপহরণের জন্য আলাদা ধারা নেই। তবে মানবপাচার প্রতিরোধ আইনের ৮ ধারাটি মিথ্যা প্রলোভন, ফুসলিয়ে কিংবা জোরপূর্বক নিয়ে যাওয়ার অভিযোগে ব্যবহৃত হয়। সবগুলো মামলাই এ ধারায় অর্ন্তভুক্ত।
পুলিশ সূত্র জানায়, ২০১২ সাল থেকে এ বছরের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত মানবপাচার আইনের সংশ্লিষ্ট ধারায় ৩০৬টি মামলা লিপিবদ্ধ হয়েছে। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ১৪টি মামলার। আর বিচারাধীন ১৫২টি ও তদন্তাধীন মামলা ১৪০টি।
মাজেদুল নয়ন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম