২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি না যাওয়ার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিলেও জামায়াত গো ধরায় শেষ পর্যন্ত তাতে অংশ নেয় বিএনপি। আর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নেয়নি কোনো দল।
আবার কাগজে কলমে নির্দলীয় হলেও ২০১৪ সালে উপজেলা নির্বাচন বিএনপি-জামায়াত অংশ নেয় সমঝোতা করেই। সুপ্রিম কোর্ট আইনহজীবী সমিতি, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, চিকিৎসকদের সংগঠন বিএমএ- সব ক্ষেত্রেই দেখা গেছে একই চিত্র। কিন্তু সদ্য সমাপ্ত ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দেখা গেল এই ব্যতিক্রম। মেয়র বা কাউন্সিলর পদে সমর্থন দিয়ে এই দল আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক কোনে বৈঠক করেনি, এমনকি যোগাযোগও হয়নি এ নিয়ে। ভোটের দিন বিএনপি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিলেও জামায়াত সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীরা রয়ে যায় লড়াইয়ে এবং চট্টগ্রামে দলটির একাধিক প্রার্থী জিতেছেনও নির্বাচনে।
বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে এই দুরত্ব একদিনে তৈরি হয়নি। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঠেকাতে দুই দল আন্দোলন করেছে একজোট হয়েই। তবে জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির আগে পরে বিএনপির কাছ থেকে সহায়তা না পেয়ে ক্ষুব্ধ ছিল জামায়াত। তবে তখন আওয়ামী লীগকে নির্বাচন করতে না দেয়ার আন্দোলনে থাকা জামায়াত এই বিষয়টি নিয়ে তেমন কথা বাড়ায়নি।
কিন্তু কিছুদিন আগে জামায়াতের আরেক নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁিস কার্যকরের সময়ও বিএনপির নীরবতা এবং তাদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত সহায়তা না পাওয়ায় আরও হতাশ হয় জামায়াত। এক পর্যায়ে দুই দলের মধ্যে যোগাযোগ কমে আসে।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপির সমঝোতা বৈঠক বা আলোচনা গত এক দশকে আটকে গেছে জামায়াত ইস্যুতে। জামায়াত জোটে থাকলে বিএনপির সঙ্গে আলোচনা নয়- আওয়ামী লীগের এই দাবি শুরুতে গুরুত্ব না দিলেও এখন সেই বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে দলের ভেতর। এর পাশাপাশি আন্দোলনের নামে নাশকতা, একাত্তরের ভূমিকা, জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত জামায়াতেরে সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে বাংলাদেশের বন্ধু বা দাতা হিসেবে পরিচিত বেশ কিছু দেশের কূটনীতিকরা চাপ দেয়ার পর বুধোদয় হয়েছে বিএনপি নেতাদের মধ্যে।
বিএনপির বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা এই সময়কে বলেন, ৬ জানুয়ারি থেকে খালেদা জিয়া অনির্দিষ্টকালের জন্য অবরোধ এবং পরে টানা হরতাল ডাকলেও সেই কর্মসূচির পক্ষে সেভাবে কাজ করেনি জামায়াত-কর্মীরা। দলটির সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করেও মাঠে নামানো যায়নি কর্মীদের।
অন্যদিকে এক জামায়াত নেতা বলেন, তারা বিএনপিকে কেবল দিয়ে গেছেন। বিএনপি ক্ষমতায় আসলে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের মুখোমুখি নেতাদেরকে মুক্ত করা যাবে, এমন আশা দিয়ে চাওয়া পাওয়ার তেমন হিসাব করেননি তারা। কিন্তু সে সম্ভাবনা যখন মিইয়ে যাচ্ছে তখন আর বিএনপিকে একতরফাভাবে দিয়ে যাবেন না আর তারা।
সূত্রের দাবি, এসব বিবেচনায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যদের বড় একটি অংশ চাইছে জামায়াতকে জোট থেকে বাদ দেয়া হউক। তারা খালেদা জিয়াকে এ বিষয়ে পরামর্শও দিয়েছন। কারণ পশ্চিমা বিশ্বের কূটনীতিকরাও এ বিষয়ে বার বার তাগিদ দিয়েছেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমেদ এবং ছাত্রদলের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি বজলুল করিম চৌধুরী আবেদের এর মধ্যে সম্প্রতি এ বিষয়ে হওয়া এক টেলিফোনালাপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফাঁস হয়েছে। মওদুদ এবং আবেদন দুজনই মনে করেন, জামায়াতের সঙ্গে জোটে থাকা বিএনপির জন্য আর লাভজনক নয় কোনোভাবেই, বরং তাদেরকে জোট থেকে বের করে দিলে স্বাধীনতাবিরোধীদের মদদ দেয়ার অভিযোগ থেকে মুক্তি মিলবে বিএনপির। পাশাপাশি পশ্চিমা দেশগুলোর আস্থাও অর্জন করা যাবে। তবে এ নিয়ে দল কোনো সিদ্ধান্ত না নেয়ায় হতাশার কথা জানিয়েছেন দুই নেতা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির কেন্ত্রীয় এক নেতা এই সময়কে বলেন, ২০ দলের দুই প্রধান শরিক বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। বিএনপির মধ্যে একটি অংশ আগে থেকেই আছে যারা জামায়াতকে জোটে রাখার বিরোধী। অন্যদিকে পশ্চিমা দেশগুলোও জামায়াত ছাড়তে চাপ দিচ্ছে। সবমিলিয়ে জামায়াত ছাড়তে ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) উপর চাপ রয়েছে। খালেদা জিয়াও একাধিকবার বলেছেন, জামায়াতের সঙ্গে তাদের জোট আদর্শিক নয়, নির্বাচনী।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান দুই দলে টানাপড়েনের কথা স্বীকার করে বলেন, ‘জোটের ভেতরে কিছু সমস্যা থাকতেই পারে। তবে জামায়াতকে জোটে রাখা না রাখার সিদ্ধান্ত আমাদের ওপরে না। এটা নির্ভর করছে খালেদা জিয়া উপর।