“ মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম পরিচালনায় জেলা প্রশাসক, কুষ্টিয়া -এঁর অবদান।”

খাইরুল ইসলাম,কুষ্টিয়া :
‘তথ্য-প্রযুক্তি শিক্ষা নয়, শিক্ষায় তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার’-এই শ্লোগানকে সামনে রেখে ২০১২ সালের ২০ মে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশের সকল মাধ্যমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ও শিক্ষক কর্তৃক ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করতে শিক্ষায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সমন্বয় অপরিহার্য। বিশ্বায়নের যুগে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি একটি অন্যতম হাতিয়ার হিসাবে কাজ করে। বাংলাদেশ এই সত্যকে উপলব্ধি করে গত দশক থেকে শিক্ষায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধিতে ব্যাপকহারে কাজ করছে।
২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রোগ্রামের উদ্যোগে ৭টি বিদ্যালয়ের ২৩ জন শিক্ষক নিয়ে শিক্ষককেন্দ্রিক শিখন-শেখানো পরিবেশের পরিবর্তে শিক্ষার্থীবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে পাইলট আকারে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম কার্যক্রম শুরু করা হয়েছিল। এ পাইলট কর্মসূচির সফল অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে, এটুআই প্রোগ্রামের সহযোগিতায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সারাদেশে পঁচিশ হাজারের বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করেছে।
কুষ্টিয়া জেলার শিক্ষকগণ কিছুদিন পূর্বেও মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম কি এবং এর ব্যবহারিকতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিলেন। কুষ্টিয়া জেলার সম্মানিত জেলা প্রশাসক জনাব , সৈয়দ বেলাল হোসেন মহোদয় প্রত্যেক শিক্ষককে অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে বের হয়ে এসে এবং মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ব্যবহারের মাধ্যমে গতানুগতিক শিক্ষক-কেন্দ্রিক শিক্ষা কার্যক্রমকে শিক্ষার্থী-কেন্দ্রিক আনন্দময় শিক্ষায় রূপান্তর করতে উদ্বুদ্ধ করেন। জেলা প্রশাসক, কুষ্টিয়া মহোদয়ের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমে শিক্ষকগণ নিজেদের তৈরিকৃত ডিজিটাল কনটেন্ট ব্যবহার করে অত্যন্ত আনন্দদায়ক ও কার্যকরভাবে শ্রেণিপাঠ পরিচালনা করছেন এবং শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে অংশগ্রহণমূলক পরিবেশে শিখতে পারছে। মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের মাধ্যমে পাঠকে আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করা, কঠিন বিষয় সহজভাবে তুলে ধরা, শিক্ষার্থীদের সহজে শিখন কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা এবং সৃজনশীল প্রশ্নের অনুশীলন কার্যক্রম খুব সহজভাবেই পরিচালনা করা যায় উক্ত বিষয়গুলো কুষ্টিয়া জেলার শিক্ষকগণ প্রমাণিত করে বার বার মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম এ্যাওয়ার্ড ও সেরা কনটেন্ট নির্মাতা হিসেবে পুরস্কার লাভ করে কুষ্টিয়া জেলার গৌরব বহুলাংশে বৃদ্ধি করছেন।উল্লেখ্য যে, জেলা প্রশাসক মহোদয় শিক্ষকগণকে শুধু মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ব্যবহারের উপর গুরুত্ব আরোপ করেই ক্ষান্ত হননি বরং তিনি শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীর আসনে বসে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম উপভোগ করে যাচ্ছেন।
কুষ্টিয়া জেলার ২৮০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা) মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপিত হয়েছে। এ সকল উপকরণ সরবরাহ করার পূর্বে প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের একজন শিক্ষককে ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি এবং মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করে শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের উপর পাবনা সরকারি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ থেকে ১৪ দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। অবশিষ্ট ১৮৬টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যাদের বিদ্যুৎ সংযোগ আছে এমন ১৩৯টি প্রতিষ্ঠানে ঐ সকল সামগ্রী সরবরাহের লক্ষ্যে তালিকাসহ ০১ জন শিক্ষক ও ০১ জন বিকল্প শিক্ষককে মনোনয়ন দিয়ে তালিকা প্রকল্প পরিচালক বরাবর ও সরকারি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ, যশোর প্রেরণ করা হয়েছে। শীঘ্রই এ সকল প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে ডাকা হবে এবং প্রশিক্ষণ শেষে উল্লিখিত সামগ্রী সরবরাহ করা হবে।
প্রতিষ্ঠান প্রধান ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের মাঝে সমন্বয় বিধান করে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম কার্যকরীকরণের কাজকে আরো গতিশীল করার লক্ষ্যে গত ২৩-০৮-২০১৪ খ্রি. কুষ্টিয়া শিল্পকলা একাডেমি অডিটোরিয়ামে ২৮০টি প্রতিষ্ঠান প্রধান ও ২৮০ জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষককে নিয়ে জেলা প্রশাসন এর আয়োজনে এবং এটুআই প্রকল্পের সহযোগিতায় দিনব্যাপী বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা ও মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। কুষ্টিয়া জেলার মাননীয় জেলা প্রশাসক সৈয়দ বেলাল হোসেন প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থেকে শিক্ষকদের সাথে মতবিনিময় করেন ও দিক নির্দেশনা প্রদান করেন। উক্ত অনুষ্ঠানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আইসিটি প্রকল্পের ডেপুটি প্রজেক্ট ডিরেক্টর ও এটুআই প্রকল্পের সহকারী গবেষণা কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।
মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ও ল্যাপটপ প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের ০১জন করে শিক্ষককে জেলা শহরে এনে প্রজেক্টর ব্যবহার এর উপর ০১দিন ও ল্যাপটপকে ভাইরাসমুক্তসহ সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার এর উপর একদিন দোয়েল ল্যাপটপ কোম্পানীর পক্ষ থেকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
এ পর্যন্ত অত্র জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে ৬০০জন শিক্ষক ডিজিটাল কনটেন্ট ডেভেলপমেন্ট তৈরীর উপর প্রশিক্ষণ পেয়েছে। জেন্ডার সমতা রক্ষার জন্য তাদের প্রায় ৩০% মহিলা। এদের মধ্যে ৫০ জন প্রতিষ্ঠান প্রধান ও আছেন। এ ছাড়া প্রতিমাসে ১৫ জন করে দু’ব্যাচে ৩০ জন শিক্ষক উক্ত বিষয়ের উপর ১৪ দিনের প্রশিক্ষণে প্রেরণ করা হচ্ছে। এক বছর পূর্বে যে সকল শিক্ষক ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরীর উপর প্রশিক্ষণ পেয়েছে ইতিমধ্যে তাদের ০৬ (ছয়) দিনের ফলোআপ প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে। আমাদের জেলার ১৫জন শিক্ষক ১ম ব্যাচে প্রশিক্ষণে আছে।
এতদ্ব্যতীত অত্র জেলার প্রায় ৫০টি প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শিক্ষকদের দিয়ে In House প্রশিক্ষনের আয়োজন করা হয়েছে। ভেড়ামারা উপজেলা প্রশাসন স্থানীয় উদ্যোগে ৩০টি প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে কনটেন্ট তৈরীসহ ই-মেইল ও অনলাইন ব্যবহার করার উপর ০৭ দিনের প্রশিক্ষণ দিয়েছে।
খোকসা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের উদ্যোগে ২৪টি প্রতিষ্ঠান প্রধানকে ০৫ (পাঁচ) দিনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ০৬ (ছয়)টি উপজেলার মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান সমূহের নিয়ে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ড্যাশবোর্ডের উপর একদিনের কর্মশালা আয়োজন করা হয়েছে। উপজেলা ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ড্যাশবোর্ডের মাধ্যমে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের বাস্তব চিত্র পর্যবেক্ষণ এবং এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন নিয়মিতভাবে এটুআই কর্তৃপক্ষ বরাবর প্রেরণ করা হচ্ছে। এছাড়া জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনসমূহের আয়োজনে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ডিজিটাল উদ্ভাবনী মেলায় মাল্টি মিডিয়া ক্লাসরুম বিষয়ক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে।
২০১৩ সালে শিক্ষক বাতায়নের বাৎসরিক কনটেন্ট প্রতিযোগিতা কুষ্টিয়া জেলা থেকে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক (২৮০ জন) শিক্ষক অংশগ্রহন করতে পেরেছিল। প্রতিযোগিতার কয়েকটি রাউন্ড অতিক্রম করে শেষ পর্যন্ত সমগ্র দেশের ৩৪ জনের মধ্যে কুষ্টিয়া জেলার ০২ (দুই) জন শিক্ষক ১) জনাব রাশেদ রায়হান লিটন, সহকারী শিক্ষক, দুর্গাপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কুমারখালী, কুষ্টিয়া ও ২) জনাব রাশেদুজ্জামান রাসেল, সহকারী শিক্ষক, জগন্নাথপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কুমারখালী, কুষ্টিয়া সেরা কনটেন্ট নির্মাতা হিসাবে নির্বাচিত হন। আর সেরা ১০ জনের মধ্যে ছিলেন ০১ (এক) জন জনাব রাশেদ রায়হান লিটন, সহকারী শিক্ষক, দুর্গাপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কুমারখালী, কুষ্টিয়া । সবচেয়ে বেশি সংখ্যক প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করায় কুষ্টিয়া এটুআই প্রকল্পের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং আলোচিত হয়।
২০১৩ সালে শিক্ষক বাতায়নে সপ্তাহের সেরা ৪২ জন কনটেন্ট বিজয়ী শিক্ষকদের নিয়ে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ও বর্তমান শিক্ষা সচিব কক্সবাজার সাংস্কৃতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সেরা শিক্ষকদের নিয়ে পুরস্কার বিতরন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। তাদের মধ্যে কুষ্টিয়া জেলার ০৩ (তিন) জন যথাক্রমে ১) জনাব মোঃ রফিকুল ইসলাম, প্রধান শিক্ষক, তাহের মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ভেড়ামারা, কুষ্টিয়া ২) জনাব মোঃ আব্দুর রহিম, সহকারী শিক্ষক (তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি), হাজী ওয়াজেদ আলী মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ভেড়ামারা, কুষ্টিয়া ও ৩) মোঃ রাশেদ রায়হান (লিটন), সহকারী শিক্ষক (তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি), দূর্গাপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কুমারখালী, কুষ্টিয়া পুরস্কার পেয়েছিল। উল্লেখ্য যে, ২০১৪ সালের প্রতিযোগিতা এখনও হয়নি। ২০১৫ সালে কুষ্টিয়া জেলার গর্ব আমলাসদরপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম এ্যাওয়ার্ড পেয়েছে ।
জেলা প্রশাসক, কুষ্টিয়া মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন যে, বিংশ শতাব্দির শেষের দিকের শিক্ষার্থী এবং বর্তমান একুশ শতকের শিক্ষার্থীর চাহিদা,আগ্রহ,রুচিবোধ, ঝোঁক,চিন্তা-চেতনা প্রভৃতির মধ্যে অনেক ব্যবধান। আমাদের শিক্ষার্থীরা এখন তথ্য-প্রযুক্তি সমৃদ্ধ বিশ্বে বসবাস করছে। গতানুগতিক ধারার জ্ঞান নির্ভর শিক্ষা পদ্ধতিতে সীমিত পরিসরে শুধুমাত্র নির্ধারিত পাঠ্যপুস্তক পড়ে ভবিষ্যৎ কর্ম জীবনে প্রবেশ করা সম্ভব নয়। তাদের প্রয়োজন জীবনঘনিষ্ঠ, উচ্চতর চিন্তন দক্ষতা অর্জন সহায়ক, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার দক্ষতা অর্জনে সক্ষম শিক্ষা সুযোগের আয়োজন করা। এ লক্ষ্যকেই সামনে রেখে তিনি নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং শিখন-শেখানো পদ্ধতি এই দু’য়ের সমন্বয়ে আমাদের শিক্ষার্থীদের নিজস্ব চিন্তাশক্তি আর জ্ঞানের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ায় নিত্য নতুন জ্ঞানের উম্মেষ ঘটবে। শিক্ষায় প্রযুক্তির ব্যবহারিক দিকের যতই উন্নতি হবে আমাদের জ্ঞানের পরিমাণ খুব দ্রুত বেড়ে যাবে। অর্থাৎ শিখন-শেখানো কার্যক্রমে পরিপূর্ণতা আনতে শ্রেণীকক্ষে ব্যবহার করতে হবে তথ্য-প্রযুক্তির বিভিন্ন উপকরণ।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষিত ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পথে আরেক ধাপ এগিয়ে যাবে দেশ। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পথে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম হবে একটি মাইলফলক।
একুশ শতকের মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম হয়ে উঠুক শিক্ষার্থীদের সত্যিকারের বিকাশের সূতিকাগার -এটাই হোক আমাদের প্রত্যাশা।
তথ্যসূত্র:

https://web.facebook.com/dcofficekushtia/posts/961553193875712

Print
4182 মোট পাঠক সংখ্যা 1 আজকের পাঠক সংখ্যা

About jexpress

Close