জমির মালিকানা নিয়ে শঙ্কা কাটছে বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীদের

যশোর এক্সপ্রেস ডেস্ক: বাংলাদেশের সদ্য বিলুপ্ত ১১১টি ছিটমহলে ভূমি জরিপ কার্যক্রম শুরু হয়েছে।  আগামী ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত এ কার্যক্রম চলবে। ১৯১২-১৯১৯ সালে ভূমি জরিপের পর ছিটমহলগুলোতে এই প্রথম ৯৬ বছর পর ভূমি জরিপ কার্যক্রম শুরু করে করা হয়েছে। জরিপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রধানতঃ দখলি শর্তে লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী ও পঞ্চগড় জেলার অভ্যন্তরে অবস্থিত সদ্য বিলুপ্ত ১১১টি ছিটমহলে ভূমি জরিপ কার্যক্রম শুরু করা হয়। এর ফলে নিজ জমির দাগ নম্বরসহ মালিকানার কাগজপত্র পাবেন গত ৬৮ বছর ছিটমহলে মানবেতর জীবনযাপনে অতিষ্ঠ সদ্য বাংলাদেশিরা। তাই ভূমি জরিপ কার্যক্রম শুরু হওয়ায় এসব ছিটমহলের বাসিন্দাদের মধ্যে বইছে আনন্দের বন্যা। আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে পঞ্চগড় সদর উপজেলার সদ্য বিলুপ্ত গাড়াতী ছিটমহলের মারুপাড়া এলাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে ভুমি জরিপ কার্যক্রম উদ্বোধন করা হয়। সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) লায়লা মুনতাজেরী দীনা এ জরিপ কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। এসময় পঞ্চগড় সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ইলিয়াছ মেহেদী, পঞ্চগড় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মোমিনুল ইসলাম, সদর উপজেলা কানুনগো মকছেদ আলী উপস্থিত ছিলেন।

একইদিন সকালে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার জোংড়া ইউনিয়নের অভ্যন্তরে সদ্য বিলুপ্ত ১১৮ নম্বর বাঁশাকাটা ছিটমহলের ভূমি জরিপ দলের কার্যক্রম শুরু করা হয়। পাটগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নূরকুতুবুল আলম এবং উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট টিএম মোমিন। এসময় জরিপ কার্যক্রম গ্রুপের প্রধান কানুনগো আইয়ুব হোসেন খাঁন, সার্ভেয়ার হায়দার আলী, সেটেলমেন্ট অফিসারসহ অন্যান্য কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন। প্রসঙ্গত লালমনিরহাটের বিলুপ্ত ৫৯টি ছিটমহলে এ জরিপ কাজ একযোগে শুরু হয়েছে। জরিপ দল সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের ১১১টি ছিটমহলে মোট ১৮টি ভূমি জরিপ ওয়ার্কিং টিম গঠন করা হয়েছে।  এরমধ্যে পঞ্চগড় জেলার জন্য ৯টি। এরমধ্যে সদর উপজেলায় ১টি, বোদা উপজেলায় ৩টি এবং দেবীগঞ্জ উপজেলায় ৫টি টিম কাজ শুরু করেছে। অন্যদিকে, লালমনিরহাট সদর উপজেলার ২ টি, হাতীবান্ধার ২ টি ও পাটগ্রাম উপজেলার ৫৫ টি বিলুপ্ত ছিটমহলে ভূমি জরিপকাজ শুরু হয়েছে।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে পুরোনো  নথিপত্র বিশ্লেষণ এবং দখলের ভিত্তিতেই পরিচালিত হবে এ কার্যক্রম। ভূমি জরিপ কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে আহ্বায়ক করে আট সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া মাঠ পর্যায়ে জরিপ কার্যক্রম সম্পন্নের জন্য উপজেলার কানুনগোকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের একটি ওয়ার্কিং কমিটিও গঠন করা হয়েছে। এসব কমিটির সদস্যরা ছিটমহলের মাঠ পর্যায়ে গিয়ে  ভূমি জরিপের কাজ সম্পন্ন করবেন। জানা গেছে, ১৯৭৪ সালের মুজিব ইন্দিরা চুক্তি ভারতীয় সংসদে পাশ হওয়ার পর গত ৩১ জুলাই ভারত বাংলাদেশের মধ্যে ছিটমহল বিনিময় চুক্তি বাস্তবায়ন হয়। গত ৬৮ বছরে ছিটমহলের শক্ত কোন ভূমি ব্যবস্থাপনা ছিলনা। তারা সাদা কাগজের দলিলেই জমি কেনা বেচা করতো। বঞ্চনার অবসান হলেও ভূমির মালিকানা নিয়ে এতদিন তারা আতঙ্কেই ছিলেন। কীভাবে এই ভূমি জরিপ পরিচালিত হবে তা নিয়ে বিলুপ্ত ছিটমহলের নাগরিকদের মাঝে নানা প্রশ্ন ছিল। কারণ অনেকের জমির কাগজ পত্র ভারতের কোচবিহার এবং জলপাইগুড়িতেই ছিল।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ভারতে থাকা অনেক নথিপত্রই তারা পেয়ে গেছেন। উভয় দেশের ছিটমহলের আগের আমলের কিছু নথিপত্র পাওয়া গেছে। সাবেক ছিটমহলের ভূমি জরিপ কালে এসব নথি পত্রের সঙ্গে প্রধানত দখলের ভিত্তিতে জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। এই কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য তিনটি কমিটি কাজ করবে। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ভূমি জরিপকালে কেউ আপত্তি তুললে  উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে  জরিপ পরিচালনা কমিটি তা সমাধান করার চেষ্টা করবে। সেখানে সমাধান না হলে জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে সমাধান করে তা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হবে। পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন জানান, যদি কেউ আপত্তি উত্থাপন করে তাহলে সেগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করা হবে। ভূমি জরিপের জন্য গঠিত কমিটি বিলুপ্ত ছিটমহলে সরেজমিনে কলমি নকশা তৈরি এবং রেকর্ড অফ রাইটস ফর্মে দখলের ভিত্তিতে ভূমি মালিকানার যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করবে। ফর্মে চৌহদ্দি বর্ণনা করে সংম্লিষ্ট চৌহদ্দিভুক্ত ভূমি মালিকদের স্বাক্ষর গ্রহণ করা হবে।

এদিকে, হাতীবান্ধার উপজেলার উত্তর গোতামারী বিলুপ্ত ছিটমহলে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে ৭ সদস্যের একটি দল ভূমি জরিপ কার্যক্রম শুরু করেছেন। এ সময় তাঁরা স্থানীয়দের সাথে নিয়ে প্রধানতঃ দখলি জমিতে গিয়ে দাগ নির্ধারণসহ প্রয়োজনীয় কলম নকশা তৈরির কাজ চালিয়ে যান। ভূমি জরিপকারী ওই দলের মধ্যে ছিলেন উপজেলা কানুনগো খাদিমুল ইসলাম, ভূমি সার্ভেয়ার জাহাঙ্গীর আলম, সেটেল্টম্যান সার্ভেয়ার মনিন্দ্র নাথ বর্মণ, উপজেলা সহকারি পরিসংখ্যান কর্মকর্তা সাদেকুল ইসলাম, সহকারি সেটেল্টম্যান তোফাজ্জল হোসেন, গোতামারী ইউনিয়ন তহশীলদার আনোয়ার হোসেন ও হাতীবান্ধা থানার উপ-পরিদর্শক মকছেদ আলী। জানতে চাইলে উত্তর গোতামারী বিলুপ্ত ছিটমহলের বাসিন্দা আজিজুল ইসলাম বলেন, আমরা দীর্ঘ ৬৮ বছর পর নিজেদের জমিগুলোর প্রয়োজনীয় দাগ নম্বরসহ মালিকানা বুঝে পাওয়ার উদ্যোগে দারুণ খুশি। এতে করে আমাদের মাঝে জমি নিয়ে যে শঙ্কা কাজ করে আসছিল তা কেটে যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। হাতীবান্ধা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আজিজুর রহমান বলেন, প্রথম দিনের ভূমি জরিপকাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এই কার্যক্রম আগামী একমাস ব্যাপী চলবে বলে জানান তিনি।

 

Print
1702 মোট পাঠক সংখ্যা 1 আজকের পাঠক সংখ্যা

About jexpress

Close