যশোর এক্সপ্রেস ডেস্ক: কৃষি গবেষক ও সংগঠক আইয়ুব হোসেন (৬৪) অার আমাদের মাঝে নেই। শনিবার সকাল সাড়ে আটটার দিকে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি যশোর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। বাদ আছর মরহুমের বাড়ির আঙিনায় জানাজাশেষে তার বাড়ির পাশেই সমাহিত করা হবে বলে জানিয়েছেন তাঁর স্বজনরা। তাঁর শরীর বেশকিছুদিন থেকেই ভাল যাচ্ছিল না। গত বছরের ২১ জুলাই তাঁকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। এরপর কিছুটা সুস্থ হয়ে তিনি যশোরে ফেরেন। মাটিকে মায়ের মতো ভালোবেসে মাটি ও কৃষির উন্নয়নে জীবনভর ছুটে চলা এই মানুষটি বেশ কিছুদিন ধরেই শরীরের বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছিলেন। এর মধ্যেও মাটি-কৃষি-কৃষক ও কৃষিপণ্যের স্বাস্থ্যরক্ষায় গবেষণা ও বিভিন্ন প্রযুক্তির সমন্বয়কাজে তিনি ছুটে চলছিলেন বিরামহীন। মানুষের জন্য স্বাস্থ্যকর কৃষিপণ্যের উৎপাদনের লক্ষ্যে জীবনভর ক্লান্তিহীন ছুটে চলার কারণে নিজের দিকে ফিরে দেখার ফুরসৎ পাননি মানবদরদী এই মানুষটি। জীবনের শেষপ্রান্তে এসে যদিও তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘এই সমাজ, এই জীবন- সমাজ যার যার, জীবন তার তার। এখানে দেখার কেউ নেই।’ বয়সে ষাটের কোঠায় পৌঁছে আইয়ুব হোসেন ডায়াবেটিকস, হৃদরোগসহ শারীরিক নানা রোগে ভুগছিলেন। সুচিকিৎসার অভাবে ত্যাগী এই কৃষি গবেষক, রাজনীতিক, সাংবাদিক ও চাষীবান্ধব এই মানুষটির অবস্থা দিন দিন অবনতির দিকে যাচ্ছি বলে তার পৌত্র রাহাত হোসেন জয় জানান। আইয়ুব হোসেনের স্বজনরা জানান, তার জন্ম ১৯৪২ সালের ২৪ এপ্রিল। বাবা কৃষক আবু বক্কর শিকদার আর মা কদভানু বিবির সাত সন্তানের মধ্যে সবার বড় তিনি। যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার বন্দবিলা ইউনিয়নের কঠুরাকান্দি গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তৎকালীন সময় এই অঞ্চলে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের জোশে আইয়ুব হোসেন ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র অবস্থায় কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৫৬ সালে কৃষক সমিতির হয়ে কাজ শুরু করেন কিশোর আইয়ুব । কিশোরবেলা থেকেই সাংগঠনিক মনোভাব, অর্থাভাব, অনিয়ম আর বাউণ্ডুলে স্বভাবের কারণে ১০ম শ্রেণির পর আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ হয়নি তার। ১৯৮০ সালে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন আইয়ুব হোসেন। কিন্তু পল্লী মায়ের হাতছানি, মাটি আর মানুষের প্রতি ভালবাসার টানে রাজনীতির ‘কুটিল’ আবর্ত আটকে রাখতে পারেনি সাদামনের এই মানুষটিকে। মা-মাটির টানে কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে যুক্ত হন কৃষি গবেষণায়। বাবলা গাছের বীজ যোগাড় করে লাগিয়ে দেন বন্দবিলা, কামারগন্নে, চৈত্রবাড়িয়া, খালিয়া জহুরপুর ও কঠুরাকান্দিসহ বিভিন্ন গ্রামের রাস্তার দুই ধারে । তাতেই তার নাম হয় ‘গাছপাগল’ আইয়ুব। ১৯৭২ সালে রাজাকারের হাতে নির্যাতিত শামছু মাস্টারের মেয়ে সাহিদাকে বিয়ে করেন তিনি। সংসার ধর্মে উদাসীন আইয়ুব হোসেনের একান্ত সাধনাই ছিল কী করে গ্রামের মাঠের জমিতে ফসলের আবাদ বাড়ানো যায়। সে চিন্তা থেকে ৮০’র দশকে ঢাকার পল্টনে সিপিবির কেন্দ্রীয় অফিসে বাংলাদেশের কৃষিনীতির ওপর দুই দিনের কর্মশালায় যোগ দেন তিনি। কর্মশালায় কৃষিনীতির ওপর ধারণাপত্র উপস্থাপনা করেন প্রখ্যাত কৃষি বিজ্ঞানী ড. গুল হোসেন ও কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. ইলিয়াস। কর্মশালার উত্থাপিত বিষয় ও বিষয়ভিত্তিক আলোচনায় নতুন পথের সন্ধান পান আইয়ুব হোসেন। নেমে পড়েন কৃষি ও কৃষকের সেবায়। সেই থেকে আইয়ুব হোসেন দেশের নানা প্রান্তে ছুটে বেড়িয়েছেন। বিজ্ঞানী ও অভিজ্ঞজনদের নিয়ে গ্রামে গ্রামে মানুষকে সংগঠন ও চাষের ব্যাপারে সচেতন করে তোলার প্রাণান্ত চেষ্টা চালিছেন। এ সুবাদে তিনি দেশের কৃষক, কৃষি বিজ্ঞানী ও কৃষিবিদদের প্রিয়জন হয়ে ওঠেন। গত কয়েক বছর ধরে প্রচণ্ড অসুস্থতা সত্বেও ‘গাছ পাগল’ আইয়ুব হোসেন তার আজীবনের এই কৃষিসাধনা একদিনের জন্যও ছেড়ে থাকেননি।

‘গাছ পাগল’ আইয়ুব হোসেন অার নেই
1483 মোট পাঠক সংখ্যা 1 আজকের পাঠক সংখ্যা