রিজার্ভ লুট: দোষীদের আড়ালে রেখেই চলছে তদন্ত

এক্সপ্রেস ডেস্ক: রিজার্ভের বিপুল পরিমাণ অর্থ লুটের ঘটনায় দোষীদের সনাক্ত নয়, ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পনুরাবৃত্তি যাতে না ঘটে, তার করণীয় নির্ধারণ নিয়েই কাজ করছে তদন্ত কমিটি। ফলে দোষীদের সনাক্ত করার যে উদ্যোগ সরকার নিয়েছিল তাতে ভাটা পড়েছে। প্রকৃত দোষীদের আড়াল করতেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রভাবশালী একটি চক্র কাজ করছে। এমন অভিযোগ করেছেন খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রাষ্ট্রীয় অর্থ চুরির সঙ্গে  ব্যাংক কর্মকর্তারা জড়িত থাকলে, তাদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে। নইলে পরবর্তীতে দুস্কৃতিকারিরা আরো উৎসাহিত হবে।

আন্তর্জাতিক অর্থ বাজারে চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারি এ ঘটনার পরে মার্কিন তদন্ত সংস্থা এফবিআই দাবি করেছে, অর্থ চুরিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কমপক্ষে একজন কর্মকর্তা জড়িত রয়েছে বলে তাদের কাছে তথ্য-প্রমাণ আছে। অপরদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংক দোষ চাপাচ্ছে সুইফট ও ফেডারেল রিজার্ভ কর্তৃপক্ষের ওপর। একে অপরকে দোষারোপের মাধ্যমে মূল হোতাদের আড়াল করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সিনিয়র কর্মকর্তারা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রাষ্ট্রীয় অর্থের তদারকি প্রতিষ্ঠান হল বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই অর্থ চুরির সঙ্গে যদি ব্যাংক কর্মকর্তারা জড়িত থাকে, তাহলে তাদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে।

এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটিকে সাতটি বিষয়ের তথ্য উদঘাটন করতে দায়িত্ব দিয়েছিল সরকার। এর মধ্যে অন্যতম ছিল, এ ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কোন কর্মকর্তা জড়িত ছিল কি-না। নতুন গভর্নর ফজলে কবিরও দায়িত্ব গ্রহণ করে বলেছিলেন, দোষীদের সনাক্ত, চুরি যাওয়া অর্থ উদ্ধার ও আইটি নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করাই তার প্রথম কাজ। ফিলিপাইনের প্রচেষ্টায় ব্যবসায়ী কিম অংয়ের কাছ থেকে কিছু ডলার উদ্ধার করতে পেরেছে দেশটি। ফিলিপাইনের এএমএলসি (অ্যান্টি মানি লন্ডারিং কাউন্সিল) অর্থ পাচারের জন্য কয়েকজনকে সনাক্ত ও তাদের বিরুদ্ধে মামলা করলেও বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত দোষীদের সনাক্ত করতে পারেনি বা এ ব্যাপারে আগ্রহ নেই।

সূত্র জানায়, রিজার্ভ লুটের ৩ মাস আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্টে সিস্টেমে আরটিজিএস স্থাপনে নিরাপত্তা ফায়ারওয়াল ফেলে দেওয়া ও ১০ মাস পূর্বে ২০১৫ সালের মে ফিলিপাইনের আরসিবিসি ব্যাংকে ভুয়া কাগজ-পত্র দিয়ে অ্যাকাউন্ট খোলা একইসূত্রে গাঁথা বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। গত ১৫ মার্চ এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাটির তদন্ত করছে সিআইডি। তদন্তের দায়িত্ব নেওয়ার পরে তিন মাসের বেশি সময় পার হলেও এখনও চার্জশিট দেয়নি সংস্থাটি। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন যে, এর সঙ্গে শক্তিশালী একটি চক্র জড়িত রয়েছে। যারা বাংলাদেশ ব্যাংক ও সুইফটের অপারেশন পদ্ধতি সম্পর্কে অনেক কিছুই জানে।

অর্থ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কোন কর্মকর্তা জড়িত আছে কি-না এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটির প্রধান ফরাসউদ্দিন সাংবাদিকদের বলেছেন, এ ঘটনায় সরাসরি বাংলাদেশ ব্যাংকের কেউ জড়িত নয় বলে তদন্ত কমিটি মনে করে। তবে এক্ষেত্রে তাদের চরম দায়িত্ব জ্ঞানহীন ও অব্যবস্থাপনার প্রমাণ পাওয়া গেছে। কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলা ছিল। অথচ এই ফরাসউদ্দিনই ঘটনার শুরুর দিকে, তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার আগে সংবাদ মাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, অর্থচুরির সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের যুক্ততা অবশ্যই আছে। এখন দেখা যাচ্ছে, সরকারের কাছ থেকে দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনি নিজের অবস্থান থেকে সরে গেলেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল এক সূত্র জানায়, যদি ব্যাংকের কোন কর্মকর্তা এতে জড়িত থাকার পরেও সনাক্ত না হয়, তবে পুনরায় এরকম ঘটনা ঘটার শঙ্কা থেকেই যাবে। এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ বলেন, বিষয়টি স্পর্শকাতর। যতটুকু জানতে পেরেছি তা হল, দুটি তদন্ত কমিটি এ নিয়ে কাজ করছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকও নিজেদের মত করে তদন্ত করছে। তবে, হ্যাকিংয়ের যত ঘটনাই ঘটেছে, সর্বশেষে দেখা গেছে, তার সঙ্গে অভ্যন্তরীণ কেউ না কেউ জড়িত ছিল।

ব্যাংক কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলা ছিল- তদন্ত কমিটির এমন দায়িত্বহীন মন্তব্যের বিষয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, এটা কোন অজুহাত হতে পারে না। দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সঠিকভাবে পালন করার জন্য। এতবড় ঘটনা ঘটে গেল, রাষ্ট্রের এত বড় ক্ষতি হল, আর কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলা ছিল। তা বলে তাদেরকে অব্যাহতি দেওয়া ভুল হবে। এতে দুস্কৃতিকারিরা উৎসাহিত হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ সরানোর বিষয়ে সুইফট ও ফেডারেল রিজার্ভ আনুষ্ঠানিকভাবে বিবৃতি দিলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র বিভিন্ন সময়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মৌখিকভাবে কথা বলছেন। ফেডারেল রিজার্ভ ও সুইফটের বক্তব্যের বিরুদ্ধে এখনো কোন আনুষ্ঠানিক বিবৃতি বা তাদের কোনো বক্তব্যের প্রতিবাদ জানায়নি বাংলাদেশ ব্যাংক।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে গত ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে ১০১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার চুরি করেছে সংঘবদ্ধ দেশি-বিদেশি একটি চক্র। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক দাবি করছে, এর মধ্যে ১৯.৯৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার শ্রীলংকা থেকে ফেরত আনা গেছে। আর ৮১ মিলিয়ন ডলার রয়েছে ফিলিপাইনে। সরিয়ে নেওয়া অর্থ পাঠানো হয় ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকের মাকাতি শাখার ৫টি অ্যাকাউন্টে। এ ঘটনায় সরকারের পক্ষ থেকে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান ফরাসউদ্দিন ইতিমধ্যে প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। পুর্ণাঙ্গ রিপোর্ট জমা দিবেন জুনের প্রথম সপ্তাহ নাগাদ। প্রথম রিপোর্টের বিষয়ে গত ১৫ মে তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সুইফটের নেটওয়ার্কে আরটিজিএস (রিয়েল টাইম গ্রস সেটেলমেন্ট) নামে আন্ত:ব্যাংক লেনেদেনে আরো একটি নেটওয়ার্ক সংযোগ দেওয়া হয়। এ সংযোগ দেওয়ার আগে ১৩টি করণীয় ছিল। এর মধ্যে কোনোটি সুইফটের আবার কোনোটি বাংলাদেশ ব্যাংকের করার কথা ছিল। তবে এর মধ্যে দু-তিনটি করণীয় না করেই ২০১৫ সালের নভেম্বরে আরটিজিএস সংযোগ দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু সুইফটের অ্যান্টিভাইরাসের কারণে আরটিজিএসের সংযোগ দেওয়া যায়নি। ফলে নিরাপত্তার জন্য হার্ডওয়্যার সিকিউরিটি মডিউল (এইচএসএম) স্থাপন করার পর সংযোগটি দেওয়ার কথা ছিল। মডিউলটি আনা হলেও এখন পর্যন্ত তা স্থাপন করা হয়নি। সূত্র জানিয়েছে, মডিউল ছাড়াই সংযোগ দেওয়ার সময় অ্যান্টিভাইরাস অচল করার চেষ্টা করা হয়। পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েকজন অতি উৎসাহী কর্মকর্তার আগ্রহে অ্যান্টিভাইরাসটি ফেলে দিয়ে সচল করা হয় আরটিজিএস।

জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের কম্পিউটার নেটওয়ার্ক থেকে নিরাপত্তা ফায়ারওয়াল ফেলে দেওয়ার সময় ঊর্ধ্বতন কোন কর্মকর্তার অনুমোদন নেওয়া হয়নি। সুইফটের সঙ্গে আরটিজিএস সংযোগ দেয়ার ফলে দুর্বল হয়ে পড়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক লেনদেনে ব্যবহৃত হয়ে আসা সুইফটপদ্ধতি। এভাবে পেমেন্ট সিস্টেম দুর্বল করে পরিকল্পিতভাবে চক্রটি রিভার্জের অর্থ হাতিয়ে নেয়। রিজার্ভের অর্থ লুটের পরে কম্পিউটার ও সার্ভারে প্রবেশের অনেক তথ্য মুছে ফেলে চক্রটি। তদন্ত সংস্থা সিআইডি এই বিষয়টি গভীরভাবে গুরুত্ব দিলেও সরকার গঠিত তদন্ত কমিটি এড়িয়ে যাচ্ছে বলে সূত্র জানিয়েছে। ফিলিপাইনের প্রচেষ্টায় ব্যবসায়ী কিম অংয়ের কাছ থেকে কিছু ডলার উদ্ধার করতে পেরেছে দেশটি। কিন্তু ফিলিপাইনের পত্রিকাগুলো বলছে, দ্বিতীয় দফায় আরো ৮৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার যা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ৬ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা চুরি করে পাঠানো হয় ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। ফেডারেল রিজার্ভের সন্দেহ হলে সেই অর্থের ছাড় আটকে দেয় ফিলিপাইন। পরে সে অর্থ ফেরত নেয় ফেডারেল রিজার্ভ।

অর্থ চুরির ঘটনার কারণ ও দোষীদের খুঁজে বের করতে সরকারের পক্ষ থেকে গত ১৫ মার্চ সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অপর দুই সদস্য হলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক মোহাম্মদ কায়কোবাদ এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব গকুল চাঁদ দাস।

Print
3007 মোট পাঠক সংখ্যা 1 আজকের পাঠক সংখ্যা

About jexpress

Close