৫৪ ধারায় গ্রেফতার ও বাংলাদেশ – সৈয়দ তৌফিক উল্লাহ

সৈয়দ তৌফিক উল্লাহ
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে মুক্ত স্বাধীন জীবন যাপনের অধিকার প্রত্যেক নাগরিকেরই আছে। এটি একটি মৌলিক অধিকারও বটে্।রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি। কিন্তু এখনো এটি চলছে। আইনের শাসন ও মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষায় এ জাতি বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিল। কিন্তু আমরা আজও আইনের মাধ্যমে নির্যাতন বন্ধ করতে পারিনি। এটি খুবই হতাশ ও দুঃখজনক বটে।
আইনের ছাত্র হিসেবে যতদূর জানি, ব্রিটিশবিরোধী গণ-আন্দোলন থামাতেই ১৮৯৮ সালে ইংরেজরা সর্বপ্রথম এই আইন তৈরি করে। তারা ওই আইনের ৫৪ ধারা তৈরি করে লাখ লাখ মানুষকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করে।
ইংরেজ উপনিবেশবিরোধী আন্দোলন প্রতিহত করতে এ ধারা ব্যবহার করা হয়েছিল। পাকিস্তান আমলেও এ ধারা ব্যবহার করে বাঙালিদের গ্রেপ্তার করা হতো। বলা বাহুল্য, শতবর্ষ আগে এই আইনের জন্ম হয়েছিল জনকল্যাণে নয়, বরং নির্দয় একটি আইন হিসেবে ঔপনিবেশিকতার স্বার্থসিদ্ধির প্রেক্ষাপটে। শতবর্ষের বেশী হলেও হলেও এই নির্দয় একটি আইনের তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি।
মানুষ আটকের ক্ষমতা রাষ্ট্রের নিশ্চয় থাকবে। কিন্তু চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়ার ৫৪ ধারা তো ৫৪ ধারা নয়। ৫৪ ধারা দুশ বছর চলেছে। সেটা তো চোখ বেঁধে তুলে নিয়ে যাওয়ার ধারা ছিল না। সুতরাং এর ব্যত্যয় ঘটেছে বলেই আজ সর্বোচ্চ আদালত এগিয়ে এসেছেন। একটা যুক্তিসংগত গ্রহণযোগ্য ও মানবিক ৫৪ ধারা থাকবে, চোখ বাঁধার ৫৪ ধারা থাকবেসংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আপিল বিভাগের রায় একটি আইন এবং সেটা মেনে চলার বাধ্যবাধকতা আছে ।
এ বিষয়ে ড. কামাল হোসেন বলেন,‘ অবশ্যই। এটা যুক্তির কথা যে ৫৪ ও ১৬৭ ধারার বিষয়ে আমরা একটি আইন পাচ্ছি। এবং যেহেতু প্রধান বিচারপতি পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের ব্যাপারে সময়সীমা বেঁধে দিয়ে বিধি চালু করেছেন, তাই আমরা খুব শিগগিরই আদালতের আইন বা তাঁদের রায় পাব। এক-দেড় বছর ঝুলে থাকবে এমন আশঙ্কা করি না। তদুপরি আমরা মন্ত্রীদের আশ্বস্ত করার সূত্রেই বলতে চাই, আসুন আমরা এখনই একটি গোলটেবিল সভার আয়োজন করি। সরকার পরিচালনা করতে গিয়ে যেসব বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে, সেটা আমরাও খতিয়ে দেখতে পারি। যুক্তিসংগত হলে তা আমরা মেনে নিয়ে সে অনুযায়ী সুপারিশ রাখতে পারি। সরকারকে ১০০ ভাগ সাহায্য করতে চাই। আমরা সবাই মিলে দেখতে পারি, একটি সভ্য রাষ্ট্রে কীভাবে গ্রেপ্তার ও রিমান্ডের ক্ষমতা প্রয়োগ করা হয়। এটা এ দেশে সম্ভব। কারণ, এককালে আমরা এটা করে দেখিয়েছি। আপিল বিভাগ এমন কিছু করেননি, যা নতুন বা অভাবনীয়।”
কিন্তু এ দায়বদ্ধতা আমাদের সংবিধান আদৌ রক্ষা করতে পারছে না। যুগের পর যুগ শুধু ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় ওয়ারেন্ট ছাড়া গ্রেপ্তারের ক্ষমতা স্বেচ্ছাচারীভাবে প্রয়োগ হয়ে আসছে।এ অন্যায় গ্রেপ্তার ও আটকাদেশ সংবিধানের উল্লিখিত বিধানের সঙ্গে সম্পূর্ণ অসঙ্গতিপূর্ণ। ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় বাংলাদেশের যে কোনো নাগরিকের নির্বিচারে গ্রেপ্তারের যে ক্ষমতা পুলিশের উপর অর্পণ করা হয়েছে, তা সংবিধানের চেতনার পরিপন্থী, এর প্রয়োগও ব্যক্তি স্বাধীনতায় আঘাত হানার শামিল।
গ্রেপ্তারের কারণ জানাতে হবে, রিমান্ডে নির্যাতন নয়।পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ-সংক্রান্ত ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধনের নির্দেশনা দিয়ে প্রায় ১৩ বছর আগে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছিলেন, তা বহাল রেখেছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। আইনজীবীরা বলছেন, সর্বোচ্চ আদালতের এই রায়ের ফলে ৫৪ ও ১৬৭ ধারার অপপ্রয়োগ বন্ধ হবে। ৫৪ ধারায় কাউকে গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে পুলিশ স্বেচ্ছাচার করতে পারবে না। আবার এই ধারায় গ্রেপ্তার কাউকে নিবর্তনমূলক আটকাদেশ দেওয়া যাবে না। ১৬৭ ধারায় রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ হবে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায়। জিজ্ঞাসাবাদের না্মে কাউকে নির্যাতন করতে পারবে না পুলিশ।কিন্তু শুধু এ অজুহাতই কি ওটা বাতিলের জন্য যথেষ্ট? যদি তাই হয়, তাহলে ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি, ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইন, ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি অদ্যাবধি বাংলাদেশে ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় মৌলিক আইন।
পুলিশের বড় কর্তাদের দাবি অনুযায়ী ওই আইনগুলোও বাতিল হওয়া দরকার, যেহেতু সেগুলো ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে প্রণীত।তাদের ওই পুলিশ আইনের ব্যাপারে গায়ে জ্বালা পোড়ার প্রধান কারণ মূলত ওই আইনের ৪ ধারা, যেখানে উল্লেখ রয়েছে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সাধারণ নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধানে থেকে জেলা পর্যায়ে পুলিশ সুপার ও অধীনস্থ অন্য অফিসাররা দায়িত্ব পালন করবেন।১৯৭৫ সালের ১০ ডিসেম্বর তৎকালীন সামরিক শাসক মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক সার্কুলারের মাধ্যমে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক জেলা পর্যায়ে পুলিশের এসপি ও অন্যান্য অফিসারের এসিআর অর্থাৎ বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন লেখার বিধান স্থগিত করেন।
পুলিশ রেগুলেশন (পিআরবি) ১৯৪৩-এর ৭৫ক নং রেগুলেশন বলে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ওই এসিআর লিখতেন। ১৮৬১ সালের পুলিশ আইনের ৪ ধারার বিধানকে বাস্তবে কার্যকর করার জন্য পিআরবিতে এরকম বিধান করা হয়েছিল। পিআরবি একটি পূর্ণাঙ্গ ও বিস্তারিত আইনগত রূপ, যার দ্বারা পুলিশ বাহিনী তার সব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকে। এটি ১৮৬১ সালের পুলিশ আইনের ভিত্তিতে সৃষ্ট। সত্যিকার অর্থে পিআরবির সামান্য দু-একটি বিষয় ছাড়া অধিকাংশ বিষয় বাস্তবসম্মত এবং তা দেশ ও সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
পিআরবি’র ৭৫ক নং রেগুলেশনের মাধ্যমে ১৮৬১ সালের পুলিশ আইনের ৪ ধারার যে বাস্তবায়ন করা হতো, তা ১৯৭৫ সালের ১০ ডিসেম্বরে তৎকালীন সামরিক শাসকের হটকারী সিদ্ধান্তে অকার্যকর হয়ে যায়।
ফলে আইন থাকলেও এখন তার বাস্তবায়ন নেই। যারা সমাজে আইনের প্রয়োগ ঘটাবে, তারা নিজেরাই যদি আইন না মানে তবে সমাজে আইনের শাসন নয় বরং বেআইনি শাসন প্রতিষ্ঠা হতে বাধ্য।
এ পর্যায়ে খোদ যুক্তরাজ্যে সাংবিধানিক আইনের বর্তমান হাল-হকিকত সামান্য আলোচনা করা যেতে পারে।
উক্ত আইনের সেকশন ৫৬ অনুযায়ী পুলিশ কোনো ব্যক্তিকে আটক করার ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে অবশ্যই তার আত্মীয়দের কাউকে আটকের কথা জানাবে। শুধু গুরুতর অপরাধের জন্যই এই ৩৬ ঘণ্টার সময়সীমা বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
একজন আটক ব্যক্তিকে যে কোনো সময়ে তার আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করার অধিকার দিয়েছে। তাকে আইনজীবী দেয়া সম্ভব না হলে নিজ খরচায় রাষ্ট্র একজন কর্তব্যরত আইনজীবীর ব্যবস্থা করবে।
উক্ত আইনের সেকশন ৭৬-এ কোনো স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্যকে মামলার প্রমাণ হিসেবে ব্যবহারের বিধান থাকলেও শর্ত রয়েছে যে, উক্ত বিবৃতি বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে এবং কোনো জুলুম করে নেয়া হয়নি, তা প্রমাণ করতে হবে।
অনুরূপভাবে সেকশন ৭৮ ফৌজদারি আদালতকে এই আইনের বিধান বহির্ভূত গৃহীত কোনো প্রমাণ নাকচ করে দেয়ার ক্ষমতা অর্পণ করেছে।
পুলিশ কোনো আটক ব্যক্তিকে জানিয়ে দেবে যে, তার আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ বা সাক্ষাতের সুযোগ রয়েছে এবং প্রয়োজনে বিনা ব্যয়ে সরকারি আইনজীবীর সাক্ষাত ও পরামর্শ নিতে পারেন। জিজ্ঞাসাবাদের আগে ও পরে ওই ব্যক্তির ডাক্তারি পরীক্ষা করাতে হবে। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল খারিজ করে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চ গতকাল মঙ্গলবার এই রায় দেন। আদালত বলেছেন, ৫৪ ও ১৬৭ ধারার কয়েকটি বিষয় সংবিধানের কয়েকটি অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় হাইকোর্ট কয়েক দফা সুপারিশ করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন থাকবে। ৫৪ ও ১৬৭ ধারা প্রয়োগের বিষয়ে একটি নীতিমালা করে দেওয়া হবে।
হাইকোর্টের দেওয়া রায়ে নির্দেশনাগুলোর মধ্যে ছিল, ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার কাউকে নিবর্তনমূলক আটকাদেশ দেওয়া যাবে না। কাউকে গ্রেপ্তার করার সময় পুলিশ তাঁর পরিচয়পত্র দেখাতে বাধ্য থাকবে। গ্রেপ্তারের তিন ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিকে কারণ জানাতে হবে। ওই ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন হলে ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে কারাগারের ভেতরে কাচ দিয়ে নির্মিত বিশেষ কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। কক্ষের বাইরে তাঁর আইনজীবী ও নিকটাত্মীয় থাকতে পারবেন।
ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় বলা হয়েছে, `যেকোনো পুলিশ কর্মকর্তা ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ বা পরোয়ানা ছাড়াই যেকোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে পারেন।`
৯টি কারণে এ ধারায় গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে পুলিশকে। তবে এ ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করার জন্য উপমহাদেশের বিভিন্ন আদালতের মতো বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগও সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন দিয়েছেন, যা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও অধস্থন আদালতগুলোর জন্য মেনে চলা বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
উল্লিখিত রায়ে ৫৪ ধারার অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতাকে অসাংবিধানিক ও মৌলিক মানবাধিকারের পরিপন্থী বলে ঘোষণা করা হয়েছে। আদালত রায়ে বলেন, ‘৫৪ ধারার ক্ষমতা প্রয়োগে চরমভাবে স্বেচ্ছাচারিতা লক্ষ্য করা যায়। এ ধারার ভাষাতেও অস্পষ্টতা আছে। তবে কেবল সন্দেহের বশবর্তী হয়ে যে কোনো নাগরিকের ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণ করে আটক বা প্রহরায় নেয়া অন্যায়, বেআইনি ও অসাংবিধানিক। কারণ ৫৪ ধারায় ওয়ারেন্ট ছাড়া আটক এর যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তা সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে বর্ণিত মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত বিধানগুলোর পরিপন্থী।
৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার যদি করতে হয় তা হতে হবে সুনির্দিষ্ট, বিশ্বাসযোগ্য ও যুক্তিসঙ্গত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে। কোনো ক্রমেই নাগরিকের ব্যক্তি স্বাধীনতা অন্যায়ভাবে হরণ করা যাবে না। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ ধারার ক্ষমতাবলে যখন তখন রিমান্ড চাওয়া ও মঞ্জুর করা সংবিধানের চেতনার পরিপন্থী।’ এ অবিচার বন্ধ করা অত্যাবশ্যক।
উল্লিখিত রায়ে আরো বলা হয় ‘পুলিশ সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে আমলযোগ্য কোনো অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করেই কেবল কোনো অভিযুক্ত বা সাক্ষীকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করতে পারবে। তাও গ্রেপ্তারের কারণ বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করতে হবে।
গ্রেপ্তারের পরপরই গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজনকে সংবাদ দিতে হবে। গ্রেপ্তারের সময় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকেও কারণ ব্যাখ্যা করতে হবে।’
উল্লিখিত রায় এ দেশে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। হাইকোর্ট প্রত্যাশা করেছিলেন, মাসদার হোসাইন মামলার রায়ের সুপারিশের মাধ্যমে বিচার বিভাগ পৃথক হওয়ায় ২০০৩ সালের উল্লিখিত রিট মামলার রিমান্ড ও ৫৪ ধারা সংক্রান্ত সুপারিশের আলোকেও এ সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করা হবে।
কিন্তু অদ্যাবধি তা হয়নি। এটি খুবই দুঃখজনক। যার কারণে জনগণের অধিকার প্রতিনিয়ত ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। মানুষের ব্যক্তি অধিকার ও সম্মান ক্ষুন্ন হচ্ছে।
আমাদের সংবিধানের ৩৪ অনুচ্ছেদেও গ্রেপ্তার ও আটকের ব্যাপারে পদ্ধতিগত সুরক্ষা দিয়েছে যেমন‘ গ্রেপ্তারকৃত কোনো ব্যক্তিকে যথাশীঘ্র গ্রেপ্তারের কারণ জ্ঞাপন না করিয়া পুনরায় আটক রাখা যাবে না এবং উক্ত ব্যক্তিকে তার মনোনীত আইনজীবীর সহিত পরামর্শের ও তার দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার হইতে বঞ্চিত করা যাবে না।
কাউকে গ্রেপ্তার করার সময় পুলিশ তার পরিচয়পত্র দেখাতে বাধ্য থাকবে। গ্রেপ্তারের তিন ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিকে এর কারণ জানাতে হবে। বাসা বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য স্থান থেকে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তির নিকটাত্মীয়কে এক ঘণ্টার মধ্যে টেলিফোন বা বিশেষ বার্তাবাহক মারফত বিষয়টি জানাতে হবে।
রিমান্ডের প্রশ্নে হাইকোর্টের নির্দেশনাও অমান্য করেছেন তারা। নির্বিচারে মানুষ আমাদের পবিত্র সংবিধানের বিধান প্রতিনিয়ত লংঘন হচ্ছে অথচ আমার সুশাসনের কথা বলছি। হাইকোর্ট বিভাগের গাইডলাইন সম্পর্কে অধিকাংশ জনগোষ্ঠী এখনও অজ্ঞ।
১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে বা ৫৪ ধারায় যে কাউকে আটক, ১৬৭ ধারায় তথাকথিত স্বীকারোক্তি আদায়; অতঃপর অস্ত্র উদ্ধারে যাওয়া, কল্পিত ওঁৎ পেতে থাকা সন্ত্রাসীদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়া এবং কর্তব্যরত অবস্থায় ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বা আত্মরক্ষায় পাল্টা গুলি চালানো এটা বাংলাদেশের প্রশাসনের নিত্ত-নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তিকে আটক করা হলে, আইনই হবে তার হেফাজতকারী। তাকে রক্ষা করার দায়িত্ব সম্পূর্ণই আইনের।
এটাই মানবাধিকারের কথা। কিন্তু আইন রক্ষাকারী বাহিনী তা করছে না। ৫৪ ধারায় ধৃত ব্যক্তিকে আইন বা আইন রক্ষাকারী বাহিনী নিরাপত্তা দেয়নি বা দিচ্ছে না।
১৮৫৭ সালে সিপাহী যুদ্ধের পর খোদ ব্রিটিশরাজ ভারত উপমহাদেশের ক্ষমতাভার গ্রহণ করেন। অভ্যন্তরীণ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য ১৮৬২ সালে পুলিশ বাহিনী সৃষ্টি করে পুলিশের বিধি ও কার্যপ্রণালী ধারা প্রণয়ন করা হয়।
ফলে জমিদারদের ক্ষমতায় কিছুটা ভাটা পড়লেও পুলিশের সহায়তায় তাদের আধিপত্য পূর্ণ মাত্রায়ই বজায় রাখতে সক্ষম হন। প্রজাদের স্বার্থ কিছুটা সংরক্ষণের প্রচেষ্টায় ব্রিটিশরাজ ১৮৮৫ সালে বেঙ্গল টেন্যান্সী অ্যাক্ট পাস করেন।
ফলে জমিদাররা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন ও ব্রিটিশরাজের কাছে তাদের অসুবিধার কথা তুলে ধরেন। খাজনা আদায়ের এবং প্রদেয় তদাংশ ব্রিটিশরাজকে পরিশোধ করার দায়িত্ব জমিদারদের থাকলেও খাজনা অনাদায়ের কারণে কাউকে শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা জমিদারদের নেই।
এ ধরনের নানা অসুবিধার কথা ভেবে এবং ঔপনিবেশিক শাসন পাকাপোক্ত ও চিরস্থায়ী করার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশরাজ ১৮৯৮ সালে ফৌজদারি আইন (অ্যাক্ট নং ৫, যা সিআরপিসি নামে পরিচিত), যা মূলত একটি কালো আইন পাস করেন।
উক্ত আইনের ৫৪ সেকশনে পুলিশকে ঢালাওভাবে কোনো গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়া বা কোনো ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ব্যতীত সন্দেহবশে কাউকে আদালতগ্রাহ্য অপরাধের জন্য গ্রেফতার করতে পারে সে ক্ষমতা দেয়া হয়।
১৮৬১ সালের পুলিশ আইন এ দেশে সুশৃংখল পুলিশ বাহিনীর গোড়াপত্তন করে। এর আগে এ ধরনের কোন সুনির্দিষ্ট আইন ছিল না। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, পুলিশের বড়কর্তাদের এ আইনের ব্যাপারে বড়ই গাত্রদাহ।
কারণ হিসেবে তারা দেখিয়ে থাকেন এটি ঔপনিবেশিক আমলে প্রণীত। সন্দেহ নেই, এটি ঔপনিবেশিক আমলে তৈরি।
প্রায় দেড় যুগ আগের একটি ঘটনায় করা রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল আপিল বিভাগের এই রায় দেওয়া হলো। রায়ের সময় আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা। রিট আবেদনকারীর পক্ষে ছিলেন আইনজীবী ড. কামাল হোসেন, এম আমীর-উল ইসলাম, শাহদীন মালিক, ইদ্রিসুর রহমান, সারা হোসেন প্রমুখ।
রায়ের পর সন্তোষ প্রকাশ করে কামাল হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, এটি একটি যুগান্তকারী রায়। এই রায়ের মধ্য দিয়ে গ্রেপ্তার, আটক, রিমান্ড ও জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হবে। তিনি বলেন, ঊনবিংশ শতাব্দীতে প্রচলিত অন্যায় গ্রেপ্তার, বেআইনি জিজ্ঞাসাবাদ, আটক ও অত্যাচারের ঔপনিবেশিক ও সংবিধানবিরোধী চর্চার অবসান ঘটিয়ে একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী সাংবিধানিক সুরক্ষা প্রতিষ্ঠায় এই রায় বিশেষ অবদান রাখবে।
আমীর-উল ইসলাম বলেন, সরকারপক্ষের আপিল খারিজ হয়ে যাওয়ায় হাইকোর্টের নির্দেশনা ও আপিল বিভাগের রায়ের আলোকে সংশ্লিষ্ট আইনের সংশোধন আবশ্যক।
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, মানুষের উপকারে ফৌজদারি কার্যবিধি যদি আরও সংশোধনের প্রয়োজন হয়, তাহলে তা করা হবে। আদালতের নির্দেশনা অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পাওয়ার আগে এ বিষয়ে মন্তব্য করা কঠিন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ৫৪ ধারা একটি জরুরি বিধান। এটি কীভাবে ব্যবহার করবেন, তার ওপর নির্ভর করে এর ভালো-মন্দ। তাই বলে ৫৪ ধারা খারাপ, এটা বলা কঠিন। ৫৪ ধারা তখনই প্রয়োগ করা উচিত, যখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মনে করবে, যাঁকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে তিনি একটি অপরাধ করতে যাচ্ছেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধনের নির্দেশনা দিয়ে সর্বোচ্চ আদালত যে রায় দিয়েছেন, তা যথাযথভাবে পালন করা হবে। পূর্ণাঙ্গ রায় এলে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ফৌজদারি কার্যবিধিতে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে, পুলিশের কারা ও কীভাবে গ্রেপ্তার করতে পারবেন।
শফিক রেহমানকে গ্রেপ্তারের সময় এ বিষয়টি মানা হয়নি বলে অভিযোগ আছে—সাংবাদিকদের এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, পরিচয় দিয়েই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ছাড়া দলপতি কিন্তু পোশাক পরেই গেছেন।
রিট মামলার বিবরণে জানা যায়, ১৯৯৮ সালে রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী থেকে বেসরকারি ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র শামীম রেজা রুবেলকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করা হয়। ওই বছরের ২৩ জুলাই মিন্টো রোডে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) কার্যালয়ে তাঁর মৃত্যু হয়। প্রায় একই সময়ে সীমা চৌধুরী নামের এক তরুণী চট্টগ্রামের রাউজানে পুলিশ হেফাজতে ধর্ষণের শিকার হন ও পরে মারা যান এবং অরুণ চক্রবর্তী নামের এক যুবক রাজধানীর রমনা থানায় পুলিশ হেফাজতে মারা যান।
পুলিশ হেফাজতে রুবেলের মৃত্যুর পর বিচারপতি হাবিবুর রহমান খানের নেতৃত্বে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করে সরকার। কমিশনের তদন্ত প্রতিবেদনে ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধনের পক্ষে ১১ দফা সুপারিশ করা হয়। কিন্তু এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় ৫৪ ও ১৬৭ ধারা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন করে মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন, অরুণ চক্রবর্তীর স্ত্রীসহ কয়েকজন বরেণ্য ব্যক্তি।
ওই রিট আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল বিচারপতি মো. হামিদুল হক ও বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রায় ঘোষণা করেন। রায়ে ছয় মাসের মধ্যে ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধনের জন্য সাত দফা সুপারিশ করা হয়। একই সঙ্গে আদালত ১৫ দফা নির্দেশনা দিয়ে রায়ে বলেন, আইন সংশোধনের আগেই এই ১৫ দফা নির্দেশনা মেনে চলতে হবে।
হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের অনুমতি চেয়ে (লিভ টু আপিল) রাষ্ট্রপক্ষ আবেদন করলে ২০০৪ সালে তা মঞ্জুর হয়। তবে হাইকোর্টের নির্দেশনা আপিল বিভাগ স্থগিত করেননি। পরে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। চলতি বছরের ২২ মার্চ রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের ওপর শুনানি শুরু হয়, ১৭ মে শেষ হয়। ওই দিন আপিল বিভাগ রায় ঘোষণার জন্য দিন ধার্য রেখেছিলেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, এখন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আপিল বিভাগ যেসব নির্দেশনা দেবেন, তার আলোকে আশা করি সরকার পদক্ষেপ নেবে। আসামিদের ধরার বিষয়ে কী কী করতে হবে, এ নিয়ে আদালতের নির্দেশনাগুলো বিবেচনায় নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারকে সামনের দিকে এগোতে হবে। তিনি বলেন, সব সময় আগে থেকে মামলা করে আসামি ধরা যায় না। অপেক্ষা করে বসে থাকলে আসামি পালাবে। যেমন যুদ্ধাপরাধী আবুল কালাম আজাদ গ্রেপ্তারের নির্দেশ শুনে পালিয়েছেন। একেক ঘটনায় একেক ধরনের পদক্ষেপ নিতে হয়। তবে যেটাই নেওয়া হোক না কেন, তা আদালতের নির্দেশের আলোকে নিতে হবে। আদালতও আশা করি বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করবেন।
আমরা এখানে ব্যবহার ও অপব্যবহার দুটোই তো দেখেছি। এই উপমহাদেশের উচ্চ আদালতগুলো এ বিষয়ে রায় দিয়েছেন। দশকের পর দশক আমরা গোটা উপমহাদেশে এর অনুশীলন দেখেছি। সুতরাং আমি তো এটা ভাবতেই পারি না যে কেউ ভাব নেবেন এই বলে যে, এটা নিয়ে ভাবতে বসে যেতে হবে। আগে হাইকোর্টের রায়ে ১৫ সুপারিশ আছে, সেগুলো শুনানিতে আলোচনায় এসেছে। ব্যক্তিস্বাধীনতা গণতন্ত্রের মুকুট। এটা তো কল্পনা করে খর্ব বা হরণ করা যাবে না। এটা খুবই পরিষ্কার একটি বিষয়। সর্বোচ্চ আদালত বলেছেন, মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতাকে খুশিমতো বঞ্চিত করা যাবে না।
লেখক: আইনজীবি।
তথ্য: ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি, ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইন, ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি , প্রথম আলো, পিআরবি, বাংলাদেশ সংবিধান, হিউম্যান রাইটস ল, সুপ্রীম কোর্ট, বাংলাদেশ এর সিদ্ধান্ত।

” মুক্তমত প্রকাশিত লেখকের একান্তই নিজস্ব। দৈনিক যশোর এক্সপ্রেস ডটকমের সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নেই। লেখকের বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে দৈনিক যশোর এক্সপ্রেস কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না। ”

Print
3485 মোট পাঠক সংখ্যা 1 আজকের পাঠক সংখ্যা

About jexpress

Close